প্রথাগত হরতাল, অবরোধের মতো সহিংস রাজনীতির ছক থেকে বেরিয়ে আসছে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলন মানেই হরতাল, অবরোধ বা ভাঙচুরের সহিংস রাজনীতি নয়। সমসাময়িককালে বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সরকারবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। তাই বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে সরকারি দলের তরফে নানা ধরনের ঠাট্টা তামাশা করা হয়েছে। এগুলোকে উসকানি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু বিএনপি ফাঁদে পা না দিয়ে ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করেছে।
বিএনপি সারা দেশে পদযাত্রা করেছে। মিছিলে হামলা করে নিজ কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে শোক র্যালি করেছে। দাবির স্বপক্ষে লিফলেট বিতরণ করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এসব নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেকেই। অনেকেই বলেছেন, বিএনপি বাম দল ও এনজিওদের মতো করে কর্মসূচি গ্রহণ করছে।
নানা ধরনের চাপ, বিশেষ করে হামলা, মামলা, জেল সয়ে বিএনপি নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে প্রতিপক্ষকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়নি।
সহিংস ও উগ্র কর্মসূচি দিয়ে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা যায় না। বরং কৌশলী কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি জনসাধারণকে সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। দিন দিন বিএনপির সমাবেশে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে। শুধু শ্রমজীবী মানুষই নয়, সব ধরনের মানুষই দিন দিন বিএনপির কর্মসূচিগুলোয় যাচ্ছে।
এই যে সাধারণ মানুষের পানির বোতল দেওয়া, হাত নাড়ানো—এসব বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সুফল। এই ধরনের কর্মসূচি যত বাড়বে, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তত বাড়বে। এসবই আমাদের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। কিছু পরিবর্তন বিএনপির হাত ধরে শুরু হয়েছে। বিএনপিকে পরিবর্তনের ধারা ধরে রাখতে হবে। আন্দোলনের মঞ্চকে বিএনপির নয়, সারা বাংলাদেশের মঞ্চে পরিণত করতে হবে। এই মঞ্চ হবে নিপীড়িত, নির্যাতিত, মজলুমের মঞ্চ। তবেই সাধারণ মানুষ বিএনপিকে সহায়তা করবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত শনিবারের( ২২ নভেম্বর) তারুণ্যের সমাবেশের উপস্থিতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরেও ছিল। এর আগে পল্টনে ১২ জুলাই বড় সমাবেশ করেছে দলটি। এর আগে বিভিন্ন বিভাগে তারুণ্যের সমাবেশ করেছে। গত বছর প্রতিটি বিভাগে সমাবেশ করেছে। গত সপ্তাহে দুই দিন ঢাকায় পদযাত্রা করেছে। প্রচণ্ড গরমে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সারা দেশে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন। কোথাও কোথাও পদযাত্রা কয়েক কিলোমিটার লম্বা হয়েছে। এসব পদযাত্রায় কয়েক লাখ মানুষ সারা দেশে অংশ নিয়েছেন।
তা ছাড়া এসব কর্মসূচিতে বিএনপির নেতারা খুব বেশি উগ্র ভাষায় বক্তব্য দেননি। বিশেষ করে প্রতিটি জনসভা বা সমাবেশে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মার্জিত ও পরিশীলিত ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। কোথাও বিএনপির পক্ষ থেকে গোলযোগ সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং মিরপুর বাংলা কলেজের সামনে ছাত্রলীগ হামলা করেছে। লক্ষ্মীপুরে হামলায় বিএনপির কর্মী নিহত হয়েছেন। গত বছর বিএনপির ১৮ জন কর্মী নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে ও প্রতিপক্ষের হামলায়। কিন্তু বরাবরই বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করে এর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
এখন পর্যন্ত বিএনপি কর্মসূচি পালনে সফল বলা যায়। বিএনপিকে চূড়ান্তভাবে সফল হতে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। সঙ্গে কর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে হবে। যদিও নানাভাবেই চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখের বেশি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অনেক মামলায় রায় প্রদান শুরু করেছেন আদালত। বিএনপি অভিযোগ করেছে, নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে থেকে দূরে রাখতে এসব মামলার রায় তড়িঘড়ি করে প্রদান করছেন আদালত। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
এ ছাড়া বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী গত এক দশকে গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। আহত কর্মীদের হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার মতো কাজও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন। এরপরও নেতা-কর্মীরা দলে দলে বিএনপির সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, হামলা-মামলা করে কোনো দলের রাজনৈতিক কর্মীদের আটকে রাখা যায় না।
বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো আওয়ামী লীগের কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আওয়ামী লীগ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি। তাই নানাভাবে বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া থেকে কর্মীদের বাধা দিচ্ছে। এতে তো কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং সাধারণ মানুষ বিএনপির সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন।
বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে গিয়েছিলেন আলোকচিত্রী শহীদুল আলম। সমাবেশে যোগ দিয়ে গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা বলেছেন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে তিনি ধরে নিয়ে যাওয়া ও গুম করে রাখার ঘটনা সমবেত জনতার সামনে তুলে ধরেন। কাজল ছাড়া আরও অনেকেই তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। সমাবেশে ছেলেহারা বাবার আহাজারি, স্বামী হারা স্ত্রীর কান্না, ভাই হারা বোনের দীর্ঘশ্বাস ও পিতাহারা সন্তানের চোখের জলে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে।
শুধু তাই নয়, সাধারণ নারীরাও এসব শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ নারীদের এই আগ্রহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অর্জন।
সাধারণ মানুষের মনের এই পরিবর্তনকে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগকে। সব সময় শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগের উচিত হবে সুষ্ঠু রাজনীতির পরিবেশ নিশ্চিত করা। সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।
আর বিএনপিকে এই শান্তির পথযাত্রা ধরে রাখতে হবে। জনসাধারণকে জিম্মি করে নয় বরং জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে দাবি আদায় করতে হবে। বিএনপি পরিষ্কারভাবে তাদের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিতে পারে যাতে কর্মসূচি চলাকালে সাধারণ মানুষের জানমালের কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয়। এখন পর্যন্ত চলমান আন্দোলনে বিএনপির কর্মীরা তেমনটা করেননি। তাই সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছে। গরমে পদযাত্রা চলাকালে সিএনজি থেকে বিএনপি কর্মীদের যাত্রীরা পানির বোতল ছুড়ে দিয়েছেন বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামে রাস্তার দুই পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছেন। অনেকে বাড়ির বারান্দা এসে হাত নড়েছেন।
এই যে সাধারণ মানুষের পানির বোতল দেওয়া, হাত নাড়ানো—এসব বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সুফল। এই ধরনের কর্মসূচি যত বাড়বে, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তত বাড়বে। এসবই আমাদের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। কিছু পরিবর্তন বিএনপির হাত ধরে শুরু হয়েছে। বিএনপিকে পরিবর্তনের ধারা ধরে রাখতে হবে। আন্দোলনের মঞ্চকে বিএনপির নয়, সারা বাংলাদেশের মঞ্চে পরিণত করতে হবে। এই মঞ্চ হবে নিপীড়িত, নির্যাতিত, মজলুমের মঞ্চ। তবেই সাধারণ মানুষ বিএনপিকে সহায়তা করবে।
বিএনপি যদি এভাবে সফল হতে পারে তবে ভবিষ্যতে অন্যরা চাইলেই হরতাল, অবরোধ করতে পারবে না। সহিংস আচরণের সাহস পাবে না। দিনদুপুরে পিটিয়ে মানুষ মারবে না। অফিসগামী সরকারি কর্মচারীকে বিবস্ত্র করবে না। এতে আমাদের রাজনীতি বদলে যাবে নিশ্চিতভাবেই।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক