আলেকসান্দর দুগিনের কন্যাকে কে হত্যা করল

বোমা হামলায় নিহত মেয়ে দারিয়া দুগিনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন আলেকসান্দর দুগিন
ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধ কখনো সুন্দর হয় না। যুদ্ধের গল্পটা সেই পোলিশ ইহুদি মায়ের চাওয়ার মতো হয় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বুড়ি মায়ের ছেলেটা যাচ্ছে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়তে। কৃষকের বউ সেই মা ছেলের ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলছে, ‘বাবা, একদম পরিশ্রম করবি না। একটা একটা তুর্কি মারবি আর জিরিয়ে নিবি। এই যে ব্যাগে তোর জন্য রুটি দিয়ে দিলাম।’ ছেলেটা তখন বলছে, ‘কিন্তু মা, যদি তুর্কিরা আমাকে মারে?’ বোকা মা অবাক, ‘বা রে, তোকে মারবে কেন, তুই ওদের কী ক্ষতি করেছিস?’

রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনীয়দের মারবে, কিন্তু তারা পাল্টা জবাব দেবে না? সেই জবাব যদি নোংরাও হয়, সেটাই তারা করবে। যেমন নোংরা ঘটনা হলো, রুশ দার্শনিক আলেকসান্দর দুগিনের ৩০ বছর বয়সী কন্যাকে হত্যা করা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি এই দুগিন। তিনি ইউরেশিয়া একত্রীকরণের তাত্ত্বিক, ভীষণ রকম রুশ জাতীয়তাবাদী এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার কঠিন সমালোচক।

দুগিনের ভূরাজনৈতিক চিন্তা ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত সাবেক রুশ সাম্রাজ্য এবং তার উত্তরাধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের হারানো ভূমি ফেরত আনার পক্ষে জনমত গঠন করে যাচ্ছে। এ চিন্তার প্রভাব রুশ শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক নেতৃত্বকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কাজে কাজেই দুগিন ন্যাটো ও ইউক্রেনীয় শাসকদের ঘৃণার লক্ষ্য। কিন্তু একজন চিন্তাবিদকে হত্যা করার চেষ্টা পশ্চিমাদের বহুল বন্দিত চিন্তার স্বাধীনতার নীতিকেই পরিত্যাগের শামিল।

দুগিনের ভূরাজনৈতিক চিন্তা ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত সাবেক রুশ সাম্রাজ্য এবং তার উত্তরাধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়নের হারানো ভূমি ফেরত আনার পক্ষে জনমত গঠন করে যাচ্ছে। এ চিন্তার প্রভাব রুশ শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক নেতৃত্বকেও উদ্বুদ্ধ করেছে। কাজে কাজেই দুগিন ন্যাটো ও ইউক্রেনীয় শাসকদের ঘৃণার লক্ষ্য।

আলেকসান্দর দুগিনের কন্যা দারিয়া দুগিনা (৩০) বাবার পথ ধরেই নিজেকে উদীয়মান বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ঘটনার দিন ২১ আগস্ট তিনি বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন এক ঐতিহ্যবাহী উৎসবে। মস্কো থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। সেখানে দারিয়া দুগিনা বক্তৃতাও করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরপরই একাই গাড়ি নিয়ে মস্কোর দিকে রওনা হন। দুগিনা বেরিয়ে যাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে বাবাও পিছু নেন মেয়ের। কিন্তু মেয়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই, দুগিনের প্রায় চোখের সামনে গাড়িটি বিস্ফোরিত হয়। পরে দারিয়া দুগিনার যে লাশ পাওয়া যায়, তা ছিল শনাক্তের অতীত—একেবারেই পোড়া। মেয়ের পোড়া গাড়ির কাছে মাথায় হাত দিয়ে আহাজারি করা বাবার ছবি গণমাধ্যমে এসেছে।

যদি দারিয়া আগে বের না হতেন, বাবাও যদি সেই গাড়িতে থাকতেন, তাহলে আলেকসান্দর দুগিনও একইভাবে পুড়ে কয়লা হয়ে যেতেন। রুশ কর্তৃপক্ষ বলছে, গাড়ির চালকের আসনের নিচে ৪০০ গ্রাম টিএনটি বিস্ফোরক লাগানো ছিল। সম্ভবত, টাইমার দিয়ে অথবা সুইচ টিপে বোমাটি ফাটানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি এই সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেছে। রুশ বার্তা সংস্থা তাস বলছে, ইউক্রেনের উগ্রপন্থী সামরিক সংগঠন আজভ ব্যাটালিয়নের সদস্য নাতালিয়া ভোভক নামের ৪৩ বছর বয়সী এক নারী এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। বোমা হামলার পরপরই তিনি এস্তোনিয়ায় পালিয়ে গেছেন।

নাতালিয়া ভোভক ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সঙ্গে রাশিয়ায় প্রবেশ করেন এ বছরের জুলাই মাসে। সে সময় তাঁর গাড়ির নম্বরপ্লেট ছিল ইউক্রেন থেকে বের গিয়ে আসা রুশপন্থী নব্য স্বাধীন দেশ দোনেৎস্কের। মস্কোতে তিনি ব্যবহার করেন কাজাখস্তানের নম্বরপ্লেট। আর এস্তোনিয়ায় পালানোর সময় তাঁর নম্বরপ্লেট ছিল ইউক্রেনীয়। রুশ কর্তৃপক্ষের বরাতে বার্তা সংস্থা তাস বলছে, ২১ আগস্ট নাতালিয়াও দুগিনদের সঙ্গে ওই গানের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। কিন্তু বোমা হামলার পরপরই তাঁর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা তদন্তে এও পেয়েছেন, নাতালিয়া তাঁর ১২ বছর বয়সী কন্যা নিয়ে আলেকসান্দর ‍দুগিন ও দারিয়া দুগিনা যে ভবনে বাস করেন, সেখানেই একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখান থেকেই তিনি দুগিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। রুশ হ্যাকাররা ইউক্রেনীয় সার্ভার হ্যাক করে নাতালিয়ার আজভ বাহিনীর সদস্যপদের পরিচয়পত্রও প্রকাশ করে দিয়েছে। ইউক্রেনীয়দের কাছে নাতালিয়া এখন বীর, কিন্তু রুশদের চোখে তিনি ‘নব্য নাৎসি’ গুপ্তঘাতক হিসেবে ঘৃণিত। নাতালিয়া ইউক্রেনীয় বিশেষ সংস্থার হয়ে কাজ করলেও রুশ ভূখণ্ডে এমন নাশকতার আয়োজন করা তাঁর পক্ষে একা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। স্বভাবতই ন্যাটো ও সিআইএ নেটওয়ার্কের নাম আসছে। উল্লেখ্য, দারিয়া ‍দুগিনাও বাবার পাশাপাশি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

স্বভাবতই এ ঘটনা রাশিয়াকে ভয়ানক খেপিয়ে ‍তুলেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অভিযানের পালে আরও হাওয়া জুগিয়েছে এই ‘আন্তরাষ্ট্রীয়’ নাশকতা। পুতিনের সমর্থনও এতে আরও বাড়বে। তবে এ ঘটনায় ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্রা ও পদ্ধতির বদলের দিকে ইঙ্গিত করে।

পশ্চিমাদের বিপুল সামরিক-আর্থিক, এমনকি গোপনে যোদ্ধা সরবরাহের পরও ইউক্রেন তার বিপুল এলাকা হারিয়ে ফেলেছে রুশ বাহিনীর হাতে। দেখা যাচ্ছে, ক্রিমিয়া, দনবাসসহ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল থেকে রুশ দখলদারি সরানোর উপযুক্ত অভিযান চালানোর সেনাসমাবেশ তারা করতে পারছে না। এমনকি ইউক্রেনের হাতে এমন কোনো দূরপাল্লার মিসাইলও নেই, যা দিয়ে তারা রুশ ভূখণ্ডে হামলা চালাতে পারে। এ রকম অবস্থায়ই গত এক সপ্তাহে ঘটল তিনটি ঘটনা। ক্রিমিয়ায় রুশ নৌবাহিনীর সদর দপ্তরসহ দুটি জায়গায় ড্রোন হামলা হলো এবং তারপর খোদ মস্কোর কাছে ঘটল এ হামলা। বোঝা যাচ্ছে, সামর্থ্য কমে আসায় ইউক্রেন এখন গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি নিয়েছে। তাদের নিশানায় রয়েছে ক্রিমিয়া ও দোনেৎস্কের মতো রুশ দখলীকৃত এলাকা। এ ছাড়া মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গও রয়েছে হামলার ঝুঁকিতে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যে প্রচলিত সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তা ইউক্রেনের এই গেরিলা হামলা মোকাবিলায় সক্ষম নয়।

ইউক্রেন থেকে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ২০১৪ সালে। আর রাশিয়ার হাত থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত ইউক্রেন নেয় ২০১৯ সালের মার্চে। রুশ হামলা শুরু হওয়ার প্রায় এক বছর আগে। এ থেকে এটাও বোঝা যায়, পুতিন যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু করার অভিযোগ করে আসছেন, তা পুরোপুরি প্রচারণা নয়। রুশভাষী ইউক্রেনীয় শহর দনবাসেও ইউক্রেন লাগাতার বোমাবর্ষণ করে আসছিল।

ওপরে বলা তিনটি চোরাগোপ্তা হামলা এটাও বোঝায়, পশ্চিমাদের যে সমর্থনের আশায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে উসকানি দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে রকম সামরিক সমর্থন আসলে কমে আসছে। ত্রাণ ও মাঝারি মাত্রার অস্ত্র এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ ছাড়া পশ্চিমাদের তেমন কিছু করারও নেই। সেটা করতে গেলে বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। বিশেষ করে তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা ঘনীভূত হওয়ায় ইউক্রেনের পাল্লাটা অনেক হালকা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় গেরিলা যুদ্ধ ছাড়া ইউক্রেনের আর কী করার আছে?

অর্থনৈতিক ময়দানেও পশ্চিমারা সুবিধা করতে পারেনি। অবরোধের পরেও রুশ মুদ্রা এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী। তেল, গ্যাস ও গমের জন্য বিশ্বও রাশিয়ার মুখাপেক্ষী। সুতরাং প্রথম দিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিকল্পনা থমকে গেলেও পুতিন এখন গুছিয়ে নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার মনোবলের একটা আভাস পাওয়া যায় আলেকসান্দর দুগিনের মন্তব্যে। মেয়ের মৃত্যুর পর তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের জন্য বলেন, ‘রাশিয়ার শত্রুরা আমার কন্যাকে হত্যা করেছে। কিন্তু আমরা, আমাদের জনগণ এ রকম অসহনীয় আঘাতের পরও ভেঙে পড়বে না...আমাদের হৃদয় কেবল প্রতিশোধ চায় না, প্রতিশোধ খুব ছোট হয়ে যায়, অরুশীয় হয়ে যায়। একমাত্র বিজয়ই আমাদের চাহিদা।’

দেখা যাক, পুতিন কীভাবে দুগিনের ডাকে সাড়া দেন।

তবে রুশরা কষ্টসহিষ্ণু জাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটির ওপর বেশি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তারা হিটলারকে পরাজিত করেছিল। সে সময়ের সোভিয়েত নেতা স্তালিনের ছেলেও সেই যুদ্ধে নিহত হন। স্তালিনপুত্র ইয়াকভের মুক্তির বিনিময়ে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে আটক একজন জার্মান ফিল্ড মার্শালকে মুক্তি দেওয়ার কথা বলেছিল জার্মান বাহিনী। সেটা শুনে স্তালিন বলেছিলেন, ‘ইয়াকভের মতো কত সোভিয়েত সেনা বন্দিশিবিরে আছে। তারা সবাই আমার সন্তান। আমি এক ইয়াকভের বিনিময়ে কোনো জার্মান ফিল্ড মার্শালকে মুক্তি দেব না।’

স্তালিন স্বৈরাচারী হতে পারেন, পুতিন একনায়ক হতে পারেন, কিন্তু আপনজনের জন্য তাঁরা আপস করেন না। উগ্র জাতীয়তাবাদী দুগিনও তাই বলেতে পারেন, ‘আমার কন্যা মাতৃভূমির মুক্তির যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।’

  • ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।

    faruk.wasif@prothomalo.com