মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভীড়
মেট্রোরেলে যাত্রীদের ভীড়

মতামত

মেট্রোরেলের যত্ন নিন

১৪ ফেব্রুয়ারি। খবরের শিরোনাম, মেট্রোরেলে ঘুড়ি আটকে মেট্রোরেল সার্ভিস ব্যাহত। ১৫ ফেব্রুয়ারি। খবরের শিরোনাম: সিগন্যাল সিস্টেমে ত্রুটি, দেরিতে চলছে মেট্রোরেল। ১৭ ফেব্রুয়ারি। খবরের শিরোনাম: ৪০ মিনিট বন্ধ থাকার পর আবার চালু মেট্রোরেল।

আরও আছে, গত ২৩ জানুয়ারি মেট্রোরেলের বিদ্যুৎলাইনে স্যাটেলাইট টিভির কেব্‌ল নিক্ষেপ, ট্রেন চলাচল বন্ধ। আর তারও আগে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে মেট্রোরেল বন্ধ ছিল। 

ঘন ঘন মেট্রোরেলের নির্বিঘ্ন চলাচলে বাধায় মনের মধ্যে কু ডাক দেয়। কেন বলি। মেট্রোরেল আসলে ঢাকাবাসীর কাছে কী? ধরুন, দরিদ্র নারী যাঁর ১২ হাত শাড়ি জোটাতে কষ্ট হয়, তাঁর যত্ন করে তোরঙ্গে তোলা শাড়ির মতো। মেট্রোরেল যেদিন মাথার ওপর চলতে শুরু করল, সেদিন আমার মতো কলার উঁচিয়ে আরও অনেকেরই টুনটুনি হতে ইচ্ছা হয়েছিল। সেই যে টুনটুনি রাজাকে বলেছিল, ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে!’ এই বিশৃঙ্খল, আবর্জনাময় ও বিশ্বের অন্যতম বসবাস-অযোগ্য নগরের মানুষ উন্নত শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকাকে এক কাতারে দেখতে শুরু করেছিল।

এই মানুষেরা তো ঘুম থেকে উঠে রংচটা, তুবড়ে যাওয়া বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলে ঝুলে কর্মস্থলে পৌঁছাতেন, ফিরতেনও একই কায়দায়। উপরি হিসেবে জুটত বাস কন্ডাক্টর, সহযাত্রীদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, কখনো ঘাড়ধাক্কা, দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানোয় জরিমানা, বসের বা স্বজনদের ঝাড়ি। ঢাকার যেসব এলাকা এখনো মেট্রোরেলের বাইরে, সেখানকার চিত্র এখনো বিবর্ণ। ঢাকার মানুষ আর কিছুতেই মেট্রো-পূর্ব জীবনে ফিরতে চায় না। 

সে কারণে মেট্রোরেল তৈরির সময়ের ভোগান্তি, দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয় বৃদ্ধি কিংবা ভাড়া—সবকিছুকেই তাঁরা মেনে নিয়েছেন। সেই মেট্রোরেল থমকে গেলে, ঢাকাবাসীর হৃৎপিণ্ডও কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তাই মেট্রোরেলে ত্রুটি দেখা দিলে তাঁরা হাহাকার করেন। এই যেমন বিবিসি বাংলার সাংবাদিক আকবর হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘মেট্রোরেলের ওপর ভরসা করা দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একেক দিন একেক রকম সমস্যা।’ 

সন্দেহ নেই, মেট্রোরেল ঢাকার সিংহভাগ বাসিন্দার জন্য যেমন নতুন অভিজ্ঞতা, তেমনি মেট্রোরেল পরিচালনার সঙ্গে যুক্তদের জন্যও।

কয়েক দিন আগেই প্রথম আলো কর্মকর্তাদের বরাতে খবর ছেপেছিল যে, মেট্রোরেলের দক্ষ জনবলের অভাব আছে। ফলে নিত্যনতুন সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ সংকটে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কর্তৃপক্ষের যে দায় আছে, সেটা অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। 

নিবন্ধটি লেখার আগে জাপান সরকারের ওয়েবসাইট ঘুরে এলাম। টোকিও শহরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত ইয়ামানোতে লাইনে প্রতি সপ্তাহে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। দুই ট্রেনের মধ্যে বিরতি ২ মিনিট। তারা রেল ব্যবস্থাপনা সচল রাখতে অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে।

রিয়েল টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে আগেই জেনে রাখছে কোনো লাইনে ত্রুটি আছে কি না। আগাম জানা থাকায়, বড় বিপর্যয়ের আগেই তারা মেরামতের কাজ সেরে রাখছে। ফলে রেল চলছে নিরবচ্ছিন্ন। পাশের দেশ ভারতেও মেট্রো চলছে বীরদর্পে।

গত বছরের ১৪ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়া কীভাবে মেট্রোরেল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে, তা নিয়ে প্রতিবেদন ছেপেছে। তারা লিখেছে, কর্তৃপক্ষ অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে রাত ১১টা থেকে ৬টার মধ্যে নিয়মিত রেলের মেরামতি কাজ চালিয়ে যায়।

এই তো সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রোরেলে আমার সহযাত্রী হলেন এক দম্পতি। লুঙ্গি ও গেঞ্জি গায়ে পুরুষটির কোলে আর বোরকা পরা নারীর হাতে এই দম্পতির আরেক শিশুর সঙ্গে দেখা হলো। বসার জায়গা পায়নি ওরা। মেট্রোরেল ছুটতে শুরু করতেই শিশু দুটির মুখে দেখা গেল স্বর্গীয় হাসি। বললেন, ওরা বেড়াতে বেরিয়েছেন। এই মানুষগুলোর মুখের হাসি অটুট রাখার দায়িত্ব মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের। প্লিজ ভুলে যাবেন না। মেট্রোরেলের ঠিকঠাক যত্ন নিন। 

আমাদের এখানে কেন মেট্রোরেলের কোচের দরজা বন্ধ হওয়া নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে? সমস্যাটা কোথায়? কেন সিগন্যাল সিস্টেমে ত্রুটি দেখা দিচ্ছে? কেনই-বা আমরা অসতর্কভাবে ঘুড়ি উড়িয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছি? তা ছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেমে (ট্রেন চলাচলের ওপরের বৈদ্যুতিক লাইন) বিদ্যুৎ সরবরাহ কম থাকায় মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কেন এমন হলো? কাউন্টার কেন বন্ধ থাকে? ভেন্ডিং মেশিন সবাই ব্যবহার করতে জানেন না। উল্টোপাল্টা চেপে মেশিন বন্ধ করে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। স্টেশনে কি যথেষ্ট জনবলের অভাব? যাত্রীরা কি প্রয়োজনে সহযোগিতা পাচ্ছেন না?

এমন একটি পরিস্থিতিতে ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, কেন বারবার মেট্রোরেল চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সেই খবর জনগণের কাছে খোলাসা করা। তাদের বুঝতে হবে, আমরা ঘরপোড়া গরু, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। 

আপনাদের অনেকেরই নিশ্চয় দ্বিতল ভলভো বাসের কথা মনে আছে। দ্বিতল ওই বাস যখন হেলেদুলে রাজপথে চলত, তাকে রাস্তার রাজাই মনে হতো। লোকে এমনকি এটাও বলত যে ঢাকার মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে শিখিয়েছে ভলভো বাস। সুইডেন থেকে প্রায় দুই দশক আগে চড়া দামে কেনা সেই ৫০টি বাসের মধ্যে সচল আছে একটি।

খবরে প্রকাশ, বাসের যন্ত্রাংশ কিছু বছর পর নষ্ট হতে শুরু করেছিল। দফায় দফায় ভলভো বাসগুলোকে সচল রাখতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেয়। কিন্তু একটি প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়নি। শেষ পর্যন্ত ৪৯টি বাস বেচে দেওয়া হয়। তা-ও নাকি ভাঙারি দোকানে ভলভোর টুকরা বিক্রি হয়েছে।

বাংলাদেশে গণপরিবহনের উন্নতিতে কোনো সরকারের উদ্যোগই দৃশ্যমান ছিল না। ব্যস্ত সময়ে স্মার্ট গণপরিবহনে চেপে সাধারণ মানুষ কর্মস্থলে যাবেন, শিশুরা স্কুলে যাবে, তেমনটাই হওয়ার কথা। তা হয়নি কখনো। যেমন বিআরটিএর পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে ঢাকায় বাস আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৮৮৭টি, আর ওই একই বছর প্রাইভেট কার এসেছে ৯ হাজার ৬৮৭টি— প্রায় পাঁচ গুণ। 

এই তো সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রোরেলে আমার সহযাত্রী হলেন এক দম্পতি। লুঙ্গি ও গেঞ্জি গায়ে পুরুষটির কোলে আর বোরকা পরা নারীর হাতে এই দম্পতির আরেক শিশুর সঙ্গে দেখা হলো। বসার জায়গা পায়নি ওরা। মেট্রোরেল ছুটতে শুরু করতেই শিশু দুটির মুখে দেখা গেল স্বর্গীয় হাসি। বললেন, ওরা বেড়াতে বেরিয়েছেন। এই মানুষগুলোর মুখের হাসি অটুট রাখার দায়িত্ব মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের। প্লিজ ভুলে যাবেন না। মেট্রোরেলের ঠিকঠাক যত্ন নিন। 

শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

sabiha.alam@prothomalo.com