পুঁজি পাচার দমন করতে হলে যে পদক্ষেপগুলো নিতেই হবে

বর্তমানে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, ডলারের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশে পুঁজি পাচার এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে হুন্ডির বেলাগাম আধিপত্যের মতো সমস্যায় জর্জরিত। এক সাক্ষাৎকারে ড. আহসান মনসুর ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, তাহলে এক ডলারের দাম ১১২-১১৫ টাকায় স্থিতিশীল হবে। আমি তাঁর এই পরামর্শের সঙ্গে অত্যন্ত জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ, অত্যন্ত শক্তিশালী হুন্ডি ডলারের ‘প্যারালাল মার্কেটের’ অবস্থানের কারণে ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে যত দিন এই হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদা কাঠামো চাঙা থাকবে, তত দিন ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে না, কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তেই থাকবে।

আন্তব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম যত থাকবে, হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে সাত-আট টাকা বেশি দিয়ে ডলার কিনে নেবে পুঁজি পাচারকারীদের কাছে হুন্ডি ডলারের প্রবল চাহিদার কারণে। আমি মনে করি, অর্থনীতিকে স্বস্তিকর অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতেই হবে।

২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও গত চার বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত্ কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করায় দেশে দুর্নীতির তাণ্ডব পুরোদমে চালু হয়ে গেছে। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১২ নম্বর দেশের অবস্থানে রয়েছে।

১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে গড়ে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।

পুঁজি পাচার রোধকে অগ্রাধিকার দিলেই এই লক্ষ্য অর্জিত হবে, অন্য কোনো পথে নয়। ইতিমধ্যে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার বাংলাদেশ পেয়ে গেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে শ্লথ করবে। আর এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করার মতো কঠোর দমন-ব্যবস্থা নিলে আগামী মাসগুলোতে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়তে শুরু করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাহলে ২০২৩ সালের ৩০ জুন নাগাদ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে ইনশা আল্লাহ।

২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। (সরকারের ঘোষণামতে রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার)। বাংলাদেশে কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ৭-৮ টাকা রয়ে গেছে। এই দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডি ব্যবস্থাকেই চাঙা করছে, ফলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে বাধ্য। অর্থমন্ত্রীর মতে, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে আসে, আমার মতে অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডি ব্যবস্থায় দেশে আসছে। এর মানে, ফরমাল চ্যানেলে প্রতিবছর ২১-২২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলে আরও কমপক্ষে ২২ বিলিয়ন ডলার হুন্ডির মাধ্যমে আসছে!

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য দায়ী চারটি প্রধান পুঁজি পাচারপ্রক্রিয়া: ১. আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির আড়ালে ওভারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার, ২. রপ্তানিতে ব্যাপক আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার, ৩. রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে দিয়ে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক এবং ৪. দেশের ব্যাংকঋণ নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলো কর্তৃক হুন্ডিওয়ালাদের ঋণের টাকা প্রদানের মাধ্যমে এর সমপরিমাণ ডলার হুন্ডিপ্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার।

তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। পুঁজি পাচারকে কঠোরভাবে দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামানো কঠিন থেকে যাবে। সুতরাং অবিলম্বে প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণগ্রহীতারা।

হুন্ডি প্রক্রিয়ায় যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার দাবি করছে সিআইডি তার সিংহভাগ চাহিদাকারী ওপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো। পুঁজি পাচারকারীরা জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। তারা যদি ব্যাপক হারে বিদেশে পুঁজি পাচার না করত তাহলে অর্থনীতি বর্তমান সংকটে পড়ত না। তাদের আমি লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাঞ্জাবি-পাকিস্তানিদের ‘ভাবাদর্শিক দোসর’ মনে করি। এই দুশমনরা ব্যাপকভাবে পুঁজি পাচার না করলে বাংলাদেশ উন্নয়নে শ্রীলঙ্কাকে ছাড়িয়ে যেত।

পুঁজি পাচার দমনে নিচের পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য মনে করি। প্রথমত, অবিলম্বে দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হোক। বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে আমাদের খবর রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পুঁজি পাচারের প্রধান প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ইতালিতে আটটি তদন্ত দল পাঠাতে হবে কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।  

যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে সেগুলো হচ্ছে—
১. যেসব পুঁজি পাচারকারীর নাম তদন্তে উঠে আসবে তাদের বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা এবং পরিচালনা বোর্ড থেকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে; ২. এসব পাচারকারীকে নতুন কোনো ব্যাংকঋণ থেকে অবিলম্বে খারিজ করতে হবে; ৩. এদের কাছে যেসব ব্যাংকঋণ খেলাপি ঋণ হিসেবে বছরের পর বছর আটকে আছে, সেগুলো আদায় করার জন্য অবিলম্বে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে; ৪. যেসব চাকরিরত আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার এবং কর্মকর্তার নাম-ঠিকানা পাচারকারী হিসেবে উদ্‌ঘাটিত হবে তাদের বরখাস্ত করে তাদের চাকরি-পরবর্তী সব সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে; ৫. যেসব রাজনীতিবিদের নাম পাওয়া যাবে, তারা যদি সরকারে ক্ষমতাসীন দলের কেউ হয় তাদের সব পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে; ৬. যেসব রপ্তানিকারকের নাম উঠে আসবে তাঁদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে সেগুলো আদায়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। উপরন্তু তাঁরা তাঁদের রপ্তানি আয় নিয়মিতভাবে দেশে ফেরত আনছেন কি না, সেটা কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে; ৭. যেসব আমদানিকারকের নাম পাওয়া যাবে, তাঁরা ওভাইনভয়েসিং করছেন কি না, তা কঠোরভাবে পরখ করতে হবে; এবং ৮. পুঁজি পাচারকারীর নাম-ঠিকানা সংসদে উত্থাপন করতে হবে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে হবে।

তৃতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে ‘বাত্ কা বাত্’ বানিয়ে রেখে পুঁজি পাচার সমস্যার সমাধান পাওয়া অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রী যদিও দাবি করে থাকেন যে তাঁকে কেনা যায় না, তবু সাধারণ জনগণের মনে যে বিশ্বাসটা গেড়ে বসেছে, সেটা হলো দুর্নীতির ব্যাপকতা বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমল থেকে বেশি। অবশ্য আশার কথা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির মতো চলমান সংকটের মোকাবিলা করতে হলেও বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপি ও জিএনআইয়ের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ থেকে ৬ শতাংশের রেঞ্জে থাকবে বলে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি-ব্যয় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়ে ৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল, যার প্রধান কারণ ছিল এলএনজি, তেলসহ পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্টস, ভোজ্যতেল, চিনি, গম ও সারের নাটকীয় আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধি। একই সঙ্গে, আমদানি এলসি ওভারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পুঁজি পাচারও এর জন্য দায়ী ছিল। সরকার ২০২২ সালের আগস্ট থেকে কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন শুরু করায় গত পাঁচ মাসে এলসি খোলার হার প্রায় ৯ শতাংশ কমে এসেছে।

এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ‘এলসি ওভারইনভয়েসিং মনিটরিং’ ব্যবস্থা জোরদার করায় ওভারইনভয়েসিংও খানিকটা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সরকার যদি এ পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কার্যকর বাস্তবায়ন ও পুঁজি পাচারের নানা পদ্ধতির বিরুদ্ধে কঠোর দমন কার্যক্রম শুরু করে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যালান্স অব পেমেন্টসের সংকট নিরসনের পথে এগিয়ে যাবে।

আমার মতে, পুঁজি পাচার রোধকে অগ্রাধিকার দিলেই এই লক্ষ্য অর্জিত হবে, অন্য কোনো পথে নয়। ইতিমধ্যে আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার বাংলাদেশ পেয়ে গেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে শ্লথ করবে। আর এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করার মতো কঠোর দমন-ব্যবস্থা নিলে আগামী মাসগুলোতে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়তে শুরু করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাহলে ২০২৩ সালের ৩০ জুন নাগাদ আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে ইনশা আল্লাহ।

  • ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়