২১ ডিসেম্বর প্রথম আলো অনলাইনে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। লেখার শিরোনাম ছিল, ‘র্যাব বিলুপ্ত করার এখনই উপযুক্ত সময়’। লেখার মূল কথা হলো, র্যাব বিলুপ্ত করার বিষয়ে জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা।
লেখাটা প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যেই এমন একটা ঘটনা নজরে এসেছে, যাতে প্রতীয়মান হয়, র্যাব বিলুপ্তির বিপক্ষে একধরনের ‘কৌশলী প্রচারণা’ শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নানা কারণে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠা কেউ কেউ জেনে–বুঝে তাতে অংশ নিচ্ছেন। তাঁরা র্যাবের পক্ষে ‘সাফাই গাওয়ার’ জন্য নতুন ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন হয়। গণ–অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, এমপি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এ কারণে ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে স্পর্শকাতরও বটে।
এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ২৩ ডিসেম্বর র্যাব সদর দপ্তরে একটি অনুষ্ঠানে ‘আলোচক’ হিসেবে গিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। এরপর তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে র্যাব নিয়ে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি বেশ কিছু ছবি সংযুক্ত করে র্যাব নিয়ে কিছু কথা লেখেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সেই লেখা থেকে কিছু অংশ হুবহু তুলে দেওয়া হলো, ‘...এক নিকৃষ্ট স্বৈরশাসক ও এক নিপীড়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি সফল বাহিনীকে কিভাবে খুনে বাহিনীতে পরিণত করেছিল তার দৃষ্টান্ত এই RAB. প্রতিষ্ঠার পর জনমনে আশা জাগানিয়া এই বাহিনীটি পরবর্তীতে জনগনের ঘৃনা ও আতংকের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। ৫ই আগষ্ট দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এই বাহিনীটিকে কিভাবে আবার জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের বাহিনীতে পরিণত করা যায় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও নানা প্রচেষ্টা চলছে। এই বাস্তবতায় আগের অফিসারদের বাদ দিয়ে RAB কে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে।...’
র্যাবের অনুষ্ঠানে তাজুল ইসলামের ‘আলোচক’ হিসেবে যাওয়া এবং পরে ফেসবুকে তাঁর দেওয়া পোস্টটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ফেসবুক পোস্ট হিসেবে দেওয়া তাঁর ওই লেখার সারমর্ম হলো, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গঠিত র্যাব সেই সময়ে একটি ‘সফল’ বাহিনী ছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তা ‘খুনে বাহিনী’তে পরিণত হয়।
বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগ আমলে (২০০৯–২০২৪) ‘ক্রসফায়ার’, গুমসহ মানবিধকার লঙ্ঘনে র্যাবের ভূমিকা সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল; কিন্তু এর শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর থেকেই, অর্থাৎ চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই। সেই আমলেই দেশি–বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো র্যাব নিয়ে তাদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল।
র্যাব নিয়ে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন লেখক–চিন্তক ফরহাদ মজহার। ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক লেখায় তিনি বলেছিলেন, ‘র্যাব মূলত জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের প্রাইভেট আর্মি গড়ে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ।’ একই লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, ‘র্যাবের অভিযান শুরুর চার মাসের মধ্যে “ক্রসফায়ারে” ৪১ জন মানুষ খুন করা হয়েছে’ (র্যাব ও আমাদের অসুখ, প্রথম আলো, ১ নভেম্বর ২০০৪)। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, শুরুর সময় থেকে বিএনপির ক্ষমতার মেয়াদ ২০০৬ সালে শেষ হওয়া পর্যন্ত র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৮০ জন নিহত হয়েছে (র্যাবের পথচলার ২০ বছর: মানুষের মিষ্টি বিতরণ থেকে ‘ক্রসফায়ার’ বিতর্ক, বিবিসি বাংলা, ৭ মার্চ ২০২৪)।
এসব তথ্য–উপাত্ত–বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিএনপি আমলেই ‘ক্রসফায়ার’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। এ কারণে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় আসার পরপরই র্যাব বিলুপ্ত করার পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (র্যাব ও ডিজিএফআই ভেঙে দিন: মানবাধিকার সংস্থা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ মে ২০০৯)।
এ বিষয়গুলো জনাব তাজুল ইসলামের অজানা থাকার কথা নয়। কারণ, তিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এবং একই সঙ্গে রাজনীতিমনস্ক একজন ব্যক্তি (ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত তিনি এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন)। এরপরও তিনি কেন তাঁর পোস্টের মাধ্যমে র্যাব সম্পর্কে খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরলেন এবং কিছু সত্য আড়াল করার চেষ্টা করলেন? তিনি কি এভাবে র্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন—এমন প্রশ্ন ওঠা তাই খুব অস্বাভাবিক নয়।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে যেসব গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর একটা বড় অংশের সঙ্গে র্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা কয়েক মাস আগেই র্যাব বিলুপ্তির দাবি করেছেন (র্যাব বিলুপ্তির দাবি গুম হওয়া পরিবারের, যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
এই ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেন। গত ১২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তিনি র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানান। সেদিন তিনি বলেন, ‘র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ। ক্ষমতার অপব্যবহার করে গুম, হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে। তাই আমি র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানাচ্ছি’ (র্যাব বিলুপ্তির দাবি র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ, ডেইলি স্টার অনলাইন, ১২ নভেম্বর)।
এটা স্পষ্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি বাহিনী হিসেবে র্যাব বিলুপ্তির দাবিও উঠেছে। এ ছাড়া গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনও গুমের ঘটনায় জড়িতদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে (গুমের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা, প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিশন, প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
লক্ষণীয় হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটির হিসেবে তাজুল ইসলামকে ওই সব ভুক্তভোগীর প্রধান আইনজীবী বলা যেতে পারে। অন্যদিকে র্যাব হলো বিবাদী বা অভিযুক্তপক্ষ। এ বিবেচনায় তাজুল ইসলামের র্যাবের অনুষ্ঠানে যাওয়া এবং র্যাব নিয়ে ফেসবুকে তাঁর প্রচারণা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ (স্বার্থের সংঘাত) কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
‘র্যাব বিলুপ্ত করার এখনই উপযুক্ত সময়’ লেখায় বলা হয়েছিল, ‘বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের চাওয়া এবং গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের দাবির পাশাপাশি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সুপারিশ হলো র্যাব বিলুপ্ত করা। এ থেকে স্পষ্ট, র্যাব বিলুপ্ত করার বিষয়ে জনগণের একটা বড় অংশের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।’ এ রকম অবস্থায় র্যাবের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা খুবই উদ্দেশ্যমূলক। এসবের ফলে র্যাব বিলুপ্ত করার বিষয়টি ঝুলে যেতে পারে বা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক