মতামত

আমাদের সন্তানেরা যেন থাকে ডিমে-ভাতে

হাঁটতে-চলতে পাড়ার মুদিদোকানে, বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে আলোচনা-বচসায় কান পাতলে ডিমের প্রসঙ্গ শোনা যাবেই
ছবি: প্রথম আলো

‘ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে’– ডিম নিয়ে বাংলায় প্রচলিত এ ধরনের চলতি প্রবাদ-প্রবচনের কমতি নেই। আবার যাঁদের মামা-চাচারা ক্ষমতাবান, তাঁরা তো সেই গরমে রীতিমতো যখন-তখন যে কাউকে ‘ডিম দেওয়ার’ শাসানি দিতেও ছাড়েন না। কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরছে ডিমসংক্রান্ত নানা তথ্য ও তত্ত্ব। কেউ কেউ তাঁদের দেয়ালে বাংলাদেশের ডিমের সঙ্গে অন্যান্য দেশের ডিমের দামের তুলনামূলক চিত্রও দিয়ে দিচ্ছেন। ট্রল, ক্ষোভ, বিষোদ্‌গার, প্রশ্ন, যুক্তি, পাল্টা যুক্তিও আর মুফতে পরামর্শ তো আছেই। ঢালিউডের একজন রিটায়ার্ড নায়ক তো ডিমের দাম কমাতে জনগণকে এক সপ্তাহ ডিম না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ফেলেছেন।

ডিম নিয়ে শুধু যে ফেসবুকপাড়া সরগরম তা নয়; হাঁটতে-চলতে পাড়ার মুদিদোকানে, বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে আলোচনা-বচসায় কান পাতলে ডিমের প্রসঙ্গ শোনা যাবেই। তাতে ক্রেতাসাধারণের দীর্ঘশ্বাসের পাল্লাটাই যে ভারী। এর কারণ হলো, মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের দাম একলাফে (৪২-৫২ শতাংশ) বাড়ার পর পাল্লা দিয়ে বাজারে ডিমের দাম রকেটগতিতে বেড়ে চলেছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনে বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। মানে প্রতিটি ডিমে বেড়েছে আড়াই থেকে তিন টাকা। মূল্যস্ফীতির সমস্যা এখন সারা বিশ্বে। এরপরও আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ডিমের ডজন এখন বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৫ টাকা। প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিকভাবেই উঠছে, একটা ডিম উৎপাদনে ডিজেলের অবদান কত শতাংশ আর দামই বেড়েছে কত শতাংশ?

একজন পোলট্রি উৎপাদক একবার কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, কীভাবে ডিমের বাজারে কারসাজিটা চলে। কখনো কখনো বড় উৎপাদকেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ডিমের দাম কম রাখেন। বড় খামারি হওয়ায় ন্যূনতম লাভ রেখেও তাঁরা বাজারে ডিম বিক্রি করে দিতে পারেন। এতে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা মুনাফা কমে। কিন্তু ন্যূনতম এই লাভে ডিমে বিক্রি করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হন ছোট খামারিরা। এ কারণে তাঁরা মুরগি পালন বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা ও জোগানের একটা ঘাটতি তৈরি হয়। সেই সুযোগে একলাফে ডিমের দাম বেড়ে যায়।

গত কয়েক বছর বাংলাদেশের সর্বসাধারণের পাতে ডিম সাধারণ একটা পদে পরিণত হয়েছে। আমরা ডাল-ভাতের বদলে ডিম-ভাত খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষ বছরে গড়ে ১০৪ দশমিক ২৩টি ডিম খায়। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য একজন মানুষকে বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়াকে স্টান্ডার্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ডিম খাওয়া জাতি হলো মেক্সিকান ও জাপানি। একজন মেক্সিকান বছরে গড়ে ৩৬৮ ও একজন জাপানি গড়ে ৩৩৭টি ডিম খায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বছরে গড়ে ডিম খাওয়ার সংখ্যা বছরে ২০০। সে তুলনায় আমাদের ডিম খাওয়ার গড় অবশ্য বেশ কম।

তবে ডিম খাওয়ার সংখ্যা বাড়ায় নগদ কিছু জাতিগত স্বাস্থ্যসুবিধা আমরা পেতে শুরু করেছি। বাংলাদেশে খর্বাকার শিশু জন্মের হার প্রায় ১০ শতাংশ (৪১ শতাংশ থেকে এখন ৩১ শতাংশ) কমে গেছে। এ ক্ষেত্রে ডিমের একটা বড় অবদান তো রয়েছেই। অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদার অনেকটা পূরণ হচ্ছে ডিমে।

মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের পেছনের সারির একটি দেশ। বিশ্বে প্রোটিন গ্রহণের বার্ষিক গড় যেখানে ৪৮ দশমিক ২ কেজি, সেখানে ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৪ কেজি। বৈশ্বিক গড় খাদ্যের গুণগত মান ও খাদ্যনিরাপত্তার বিচারে বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার যে সূচক, তাতে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। বাংলাদেশে বিদ্যমান তীব্র আয়বৈষম্য এ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য প্রয়োজন। আর সুষম খাদ্যের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। শিশুদের জন্য প্রয়োজন প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ২ গ্রাম।

প্রোটিনের এত ঘাটতির পরেও এ দেশের মানুষের প্রতিদিনকার প্রোটিনের জোগানের একটা অংশ ডিম থেকে পূরণ হয়। একটু কম দামে পাওয়া যেত বলে ডিম গরিবের প্রোটিন বলে পরিচিত। গত বছরের নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই ডিমের বাজারে আগুন লাগা শুরু হয়। গত মাসের তুলনায় এ মাসে বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৪১ শতাংশ।

বাংলাদেশে যাঁদের বয়স পঞ্চাশের কোঠায় এবং যাঁদের শিকড় গ্রাম-মফস্বলে, তাঁরা কয়েক দশক পেছনে ফিরে যেতে পারেন। বেশির ভাগের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের পাতে ডিম খাওয়ার ব্যাপারটা কল্পনার বাইরের একটা বিষয় ছিল। আবার আস্ত ডিম খাওয়ার ব্যাপারটাও বেশ বড় একটা প্রাপ্তির মতো ছিল। অনেক বাড়িতে ডিম রান্নার পর খুন্তি কিংবা সুতা দিয়ে কেটে দুভাগ করে দুজনের পাতে তুলে দেওয়া হতো। সেই অতীত আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আমাদের এখন বেশ বড়সড় পোলট্রিশিল্প। দেড় লাখের বেশি খামার রয়েছে। মুরগি ও ডিম উৎপাদন করে কয়েক লাখ মানুষের জীবিকা হচ্ছে। বছরে ডিমের বাজারও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার। উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই তরুণ ও ছোট উদ্যোক্তা। প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি ডিম উৎপাদিত হয়।

মুরগি ও ডিমের এত বড় বাজার গড়ে উঠেছে, কিন্তু সহায়ক শিল্প গড়ে তোলার খুব একটা উদ্যোগ নেই। এ খাতের উদ্যোক্তা নেতারা বলছেন, বর্তমানে ডিমের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো সম্প্রতি পোলট্রি ফিডের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সে কারণে ছোট খামারিদের অনেকে মুরগি পালন বন্ধ রেখেছেন। চাহিদা আর জোগানের বড় একটা ঘাটতি তৈরি হয়েছে। পোলট্রি ফিডের দুটি বড় উপাদান ভুট্টা আর সয়াবিন। ভুট্টার কিছুটা দেশে উৎপাদন হলেও সয়াবিন আমদানি নির্ভর। এ ক্ষেত্রেও সংকটটা তৈরিতে অবদান রেখেছে সেই ইউক্রেন যুদ্ধ। ভুট্টার সবচেয়ে বড় উৎপাদক রাশিয়া ও ইউক্রেন। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, এত সব কারণ থাকা সত্ত্বেও ডিমের দাম এতোটা বেড়ে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? তাই অবধারিতভাবেই সিন্ডিকেটের কারসাজির প্রসঙ্গ আসছে।

ডিম পচনশীল বলে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই—এমন দাবি করেছেন এ শিল্পের বড় উদ্যোক্তারা। তবে এ ডিমে সিন্ডিকেট হয় না, সেটা বলা যাবে না। বছর তিনেক আগে মাঝারি গোছের একজন পোলট্রি উৎপাদক একবার কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, কীভাবে ডিমের বাজারে কারসাজিটা চলে। কখনো কখনো বড় উৎপাদকেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই ডিমের দাম কম রাখেন। বড় খামারি হওয়ায় ন্যূনতম লাভ রেখেও তাঁরা বাজারে ডিম বিক্রি করে দিতে পারেন। এতে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা মুনাফা কমে। কিন্তু ন্যূনতম এই লাভে ডিমে বিক্রি করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হন ছোট খামারিরা। এ কারণে তাঁরা মুরগি পালন বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা ও জোগানের একটা ঘাটতি তৈরি হয়। সেই সুযোগে একলাফে ডিমের দাম বেড়ে যায়।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি ঘটছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে। কিন্তু মানুষের আয় তো আর বাড়ছে না। এ কারণে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সংসার খরচের বাজেটে। এত দিন ডিম ছিল সাধ্যের মধ্যে। সেই ডিমও দামি এখন। খাদ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’—সপ্তদশ শতকের বাঙালি কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের সুবিখ্যাত উক্তি। খেয়া পারাপারের মাঝি ঈশ্বরী পাটনি অন্নদার কাছে তাঁর সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই বরটাই চেয়েছিলেন। বাঙালি মায়েদের চিরকালীন প্রত্যাশা, তাঁর সন্তান যেন অন্তত দুধভাত খেয়ে বেড়ে উঠতে পারে। একবিংশ শতকে এসে সেই দুধে–ভাতে অনেকাংশেই ডিমে-ভাতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই উচ্চমূল্যের বাজারে আমাদের সন্তানেরা ডিমে-ভাতে কি টিকে থাকতে পারবে?

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ই-মেইল: monoj.dey@prothomalo.com