ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার সঙ্গে পালটে যাবে বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার সঙ্গে পালটে যাবে বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ

মতামত

ট্রাম্প ফেরায় ভারত, রাশিয়া ও ইসরায়েল কেন খুশি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময়কর আর নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে। সেই সঙ্গে একটি কূটনৈতিক বলয়েরও জন্ম হয়েছে। এর নাম দেওয়া যায় ‘ট্রাম্পের অক্ষ’। এই অক্ষের উত্থানে বিশ্ব শৃঙ্খলার ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্পের এই অক্ষের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ইসরায়েল ও ভারত। এই দেশগুলো ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনুকূলভাবে দেখছে।

বাইডেনের বিপর্যয়কর পররাষ্ট্রনীতি

২০২১ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেন। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র দুটি উত্তপ্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। ইউরোপে প্রায় তিন বছর ধরে এবং মধ্যপ্রাচ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছে। পশ্চিমের প্রভাবশালী বয়ান তাদের চ্যালেঞ্জ করা দেশগুলোর নেতাদের আত্মম্ভরী অত্যাচারী হিসেবে চিত্রিত করে। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানের আলী খামেনিকে দেখানো হয় এমন ব্যক্তি হিসেবে, যাঁরা বিদেশে সমস্যা এবং স্বদেশে অত্যাচার করবেন বলেই যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

পশ্চিমা বয়ান অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য শুধু এরাই দায়ী। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন মেয়ারশাইমারসহ অনেক পর্যবেক্ষক স্বীকার করেন যে এই যুদ্ধগুলো ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প-যুগের সম্প্রসারণ নীতির মাধ্যমে মার্কিন প্রভাব বিস্তারের জন্য বাইডেনের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায়, এমন একটা স্থিতাবস্থা কায়েম হয়েছিল। তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার পরিবর্তে বাইডেন আরও বেশি কিছু চাইলেন।

মিথস অব এম্পায়ার জ্যাক স্নাইডারের ক্ল্যাসিক বই। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, যুগে যুগে সাম্রাজ্যগুলো একটা মিথে বিশ্বাস করে এসেছে। মিথটা হলো, সম্প্রসারণের মাধ্যমেই কেবল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। আর এই সম্প্রসারণ করতে গিয়েই তারা নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনে। বাইডেনের ক্ষেত্রেই তা-ই হয়েছে। তিনি সম্প্রসারণ করতে গিয়ে নিরাপত্তার বদলে বিধ্বংসী যুদ্ধ নিয়ে এসেছেন।

ভারত ভাবছে যে বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প ভারতের প্রতি বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হিংস্রতা আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিয়ে যে ভয়াবহ আচরণ করেছে মোদি সরকার, বাইডেন প্রশাসন তাতে কিছুটা চাপ দিয়েছিল। অনেক ভারতীয় এখন নিশ্চিত যে ট্রাম্প সেই সামান্য চাপও আর দেবে না।

এই দুই যুদ্ধেই, মানবাধিকার সংস্থাগুলো রাশিয়া ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু তারা এই কথা উল্লেখ করছে না যে যে কীভাবে বাইডেনের শাসনামলে মার্কিন জাতীয় স্বার্থের জন্য সমালোচনামূলক অন্তত দুটি অঞ্চলে বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মার্কিন মিত্ররা আর তাদের শত্রুদের আটকাতে পারছে না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মতো বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাহীন এবং অকার্যকর করা হয়েছে। এর জন্য দায়ী মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার যেমন খুশি তেমন ব্যবহার। রাশিয়া ও ইরান তাদের প্রতিবেশী এলাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে দিতে সফল হয়নি। তবে তারা অবশ্যই মার্কিন ক্ষমতার সীমা কত দূর, তা দেখিয়ে দিয়েছে। এসবের ফলে যে শৃঙ্খলা ধসে পড়েছে, তা সম্ভবত মেরামতের বাইরে।

পররাষ্ট্রনীতিতে বাইডেনের কয়েক দশকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। তা সত্ত্বেও তাঁর মেয়াদে মার্কিন স্বার্থকে ভালোভাবে রক্ষা করা গেছে, তা বলা যাবে না। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ওয়াশিংটন যে তিনটি অঞ্চলের প্রতি খুব মনোযোগী, সেগুলোর প্রতিটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক বিপত্তির সূচনা হয়েছে। মার্কিন মিত্র ইউরোপে ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল মরিয়া যুদ্ধ করছে।

এই যুদ্ধ তাদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যর্থতা শুধু ইন্দো-প্যাসিফিক যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল করবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি একটি বিশাল ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। কিন্তু ট্রাম্পের জয় হঠাৎ করেই বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিবেশ।

বন্ধু ও শত্রু—দুই পক্ষই এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভিন্নভাবে যাচাই করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক মাস আগেই বিভিন্ন নেতা ট্রাম্পের বাড়িতে ছুটে যাওয়া শুরু করেছেন।

ইসরায়েল

ইসরায়েলের কথা বিবেচনা করা যাক। হামাসের দ্বারা ইসরায়েলিদের ওপর হামলার পর থেকে ইসরায়েলি সরকার বিরামহীন বর্বরতার সঙ্গে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে তারা। বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে গাজাকে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এসব করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনে। বাইডেন ইসরায়েলকে দিয়েছেন বিলিয়ন ডলার সহায়তা, অস্ত্রের অবিরাম সরবরাহ এবং বাইডেনের অনুশোচনাহীন কূটনৈতিক সমর্থন। কিন্তু এখন ট্রাম্পের জয়ের পর দুই দেশের সম্পর্ক হঠাৎ করেই তিক্ত হয়ে গেছে।

ট্রাম্প তার প্রশাসনে কয়েকজন ইসরায়েলপন্থী মনোনীত করেছেন। যেমন সিনেটর মার্কো রুবিও এবং গভর্নর মাইক হাকাবি। নেতানিয়াহু ট্রাম্পের বিজয়ে এতটাই উচ্ছ্বসিত যে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে লেবাননে যুদ্ধবিরতি উপহার দিচ্ছেন। উপহার হিসেবে যুদ্ধবিরতি!

ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইসরায়েল কি ট্রাম্পের মহাপরিকল্পনাগুলোকে বিপর্যস্ত করতে ভয় পাচ্ছে? সেই অনুযায়ী কি ইসরায়েল নিজের লক্ষ্যগুলো খাপ খাইয়ে নেবে? অকুণ্ঠ সমর্থন বাইডেনের কাছে থেকে পাওয়া গেলেও ট্রাম্পের কাছ থেকে তা পাওয়া যাবেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

ভারত

ভারতীয় সংস্থাও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে রোমাঞ্চিত। ট্রাম্প মনোনীত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ এবং জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক হিসেবে মনোনীত তুলসী গ্যাবার্ডকে ভারত নিজের বন্ধু বলে মনে করে। ভারতের অনেকে মনে করেন যে গ্যাবার্ড এবং বিবেক রামাস্বামী যেহেতু হিন্দু, তাই তাঁরা ভারতের প্রতি আরও অনুগত হবেন।

ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্টের মেয়াদে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ট্রাম্প এবং মোদি যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলেছিলেন তা-ও মানুষ মনে রেখেছে। ভারত ভাবছে যে বাইডেনের চেয়ে ট্রাম্প ভারতের প্রতি বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হবেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হিংস্রতা আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিয়ে যে ভয়াবহ আচরণ করেছে মোদি সরকার, বাইডেন প্রশাসন তাতে কিছুটা চাপ দিয়েছিল। অনেক ভারতীয় এখন নিশ্চিত যে ট্রাম্প সেই সামান্য চাপও আর দেবে না।

  • মুক্তদার খান, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ার

ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন