জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় কত কিছুই না আমরা শুনেছি। বাজেট আলোচনাতেও ব্যতিক্রম হয়নি। কবিতা–গানও বাদ যায়নি। আর বন্দনা ছাড়া কোনো বক্তৃতা হয় কি না, তা সম্ভবত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আর কোনো জিজ্ঞাসা নয়। তাঁরাও এখন যেকোনো বিষয়ের বক্তৃতা শুরু করেন ‘প্রথমে বন্দনা করি’ বলে।
অপ্রাসঙ্গিক বা প্রসঙ্গচ্যুতির কারণে স্পিকার সেসব কখনো কার্যবিবরণী থেকে কর্তন (এক্সপাঞ্জ) করেছেন বলে মনে পড়ে না। প্রয়াত সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের নির্বাচন, তথা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কিছু তেতো সত্য সংসদকক্ষে উচ্চারিত হওয়ায় এখন সেগুলো কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে স্পিকার এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
সংসদ অধিবেশন সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে সংসদের বাইরে যাঁরা ওই সব বক্তব্য শুনেছেন কিংবা স্পিকারের রুলিংয়ের আগেই যেসব সংবাদমাধ্যমে তা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলো শ্রোতা-পাঠকদের মন থেকে কীভাবে মোছা হবে, তা আমাদের জানা নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনা ভোটের নির্বাচনের স্মৃতি অবশ্য অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে ২০১৮ সালের রাতের ভোটে। ২০১৮–এর স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে ২০২৪–এর পরিকল্পনা কী, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দলছুটকে জেতাতে আওয়ামী লীগের প্রাণপণ চেষ্টাকেই ‘দুষ্টু’ লোকেরা নাকি তার একটা মহড়া (রিহার্সাল) বা পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রকল্প বলে অভিহিত করতে শুরু করেছেন।
স্পিকারের এক্সপাঞ্জ করা রুলিং মেনেই গত সোম ও মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংসদ সদস্যদের বাহাস থেকে উদ্ধৃত না করেই বিতর্কের বিষয়টি আলোচনা জরুরি গণ্য করছি। বিতর্কের বিষয় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জেনারেল এরশাদের ২০১৪–এর নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার প্রশ্নটি।
সন্দেহ নেই এরশাদ সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাননি এবং তাঁর ওপরে চাপ প্রয়োগের জন্য প্রথমে তাঁকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে আনা হয় এবং সামরিক হাসপাতালে রাখা হয়। চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং তাঁর সঙ্গে দেখা করে কী বলেছিলেন, সে কথা এরশাদ নিজের জবানিতেই প্রকাশ করে গেছেন।
জেনারেল এরশাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছিলেন, সে কথাও সবার জানা। রওশন এরশাদের সিদ্ধান্তেই সেদিন জাতীয় পার্টির অন্য নেতারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
জেনারেল এরশাদের নামে যেসব আসনে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল, সেগুলোর যথার্থতা নিয়েও তখন প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি নিজের এবং দলের কোনো নির্বাচনী প্রচারেও অংশ নেননি। কিন্তু সরকারি রেকর্ডে আছে লালমনিরহাট-১ আসনে এরশাদ প্রার্থী ছিলেন এবং ভোট পেয়েছিলেন ৫ হাজার ৩৮১টি। আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মোতাহার হোসেন পান ১ লাখ ৭৯ হাজার ৮১৪ ভোট। সুতরাং নথিপত্রে জেনারেল এরশাদ ওই আসনে জামানত খুইয়েছিলেন।
মুজিবুল হক এখন স্বীকার করে নিয়েছেন যে তিনি তাঁর নেতার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিলেন। ওই বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে ছিল নেতার স্ত্রীর উৎসাহ ও যোগসাজশ। নির্বাচন না হলে কথিত ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’ তৈরির এক বিতর্কিত যুক্তি দাঁড় করানোরও চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু ওই বিশ্বাসঘাতকতা যে দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা তাঁরা কবে উপলব্ধি করবেন?
সত্য এত নিষ্ঠুর যে এই সরকারি তথ্য উচ্চারণে পরপর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী মনোনীত সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা অন্তর্জ্বালা আর সহ্য করতে পারেননি। তাঁদের প্রতিবাদ এবং পাল্টা বক্তব্য থেকেই স্পিকারের রুলিংয়ের অবতারণা। কিন্তু তারপরও এক দিনের ব্যবধানে পয়েন্ট অব অর্ডারে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক তাঁদের দলের কথাগুলো তুলে ধরেছেন, যা শুধু সরকারি তথ্যকেই যে নাকচ করে দেয়, তা নয়, বরং কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দেয়।
মুজিবুল হক বলেছেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিল। আমাদের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চূড়ান্ত সময়ে বললেন, নির্বাচন করবেন না এবং সারা দেশের সব প্রার্থীকে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি দেন। নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নেন। সেদিন এমন একটা অবস্থা হয়েছিল...বিএনপি নির্বাচনে আসে না। কোনো দল আসবে না।
জাতীয় পার্টি যদি না আসে, তাহলে বাংলাদেশে একটা অসাংবিধানিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হতো। সেই দিন বেগম রওশন এরশাদ এবং আমরা কয়েকজন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহ করে বেগম এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করেছিলাম।’ তাঁর কথায়, ‘এরশাদ সাহেব নির্বাচন করেন নাই। লালমনিরহাটে তিনি প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু তিনি (মোতাহার হোসেন) কী করে বলেন এরশাদ সাহেবকে পরাজিত করেছেন।’
এসব বক্তব্য শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্ন ওঠে, তা হলো লালমনিরহাটে নির্বাচনে জেনারেল এরশাদের মনোনয়ন বহাল রাখতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল কি না। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফল নির্ধারিত হওয়ায় বাকি ১৪৬টি আসনের চিত্র কেমন ছিল, মুজিবুল হকের বক্তব্যে তার কিছুটা ধারণা মেলে।
একটি দলের প্রধানের ক্ষেত্রে এ রকম জালিয়াতি হয়ে থাকলে বাকিদের ক্ষেত্রে যে তার চেয়ে উন্নত কিছু ঘটেছে, এমন কোনো দাবির নিশ্চয়ই অবকাশ থাকে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে এত দিন সেই নির্বাচন বর্জন করা দলগুলো প্রহসন বলে অভিহিত করে এসেছে। এখন সেই প্রহসনের ফলভোগকারী একটি দলও স্বীকার করে নিচ্ছে, সেটি ছিল প্রহসনের চেয়েও খারাপ।
মুজিবুল হক এখন স্বীকার করে নিয়েছেন যে তিনি তাঁর নেতার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিলেন। ওই বিশ্বাসঘাতকতার পেছনে ছিল নেতার স্ত্রীর উৎসাহ ও যোগসাজশ। নির্বাচন না হলে কথিত ‘সাংবিধানিক শূন্যতা’ তৈরির এক বিতর্কিত যুক্তি দাঁড় করানোরও চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু ওই বিশ্বাসঘাতকতা যে দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি হরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা তাঁরা কবে উপলব্ধি করবেন?
ওই বিশ্বাসঘাতকতা তো শুধু তাঁর নেতার সঙ্গে নয়, যার খেসারত পুরো দেশকেই দিতে হচ্ছে। জাতীয় পার্টির মহাসচিব অবশ্য একটি দিক দিয়ে তাঁর ২০১৪–এর মহাজোটের অন্যান্য সঙ্গী, সফেদ পোশাকি বামপন্থীদের থেকে এগিয়ে থাকলেন। তিনি ভুলের উপলব্ধিটা স্বীকার করেছেন, তাঁরা তা স্বীকার করেন না।
সংসদ অধিবেশনে এসব নাটকীয়তার দিনেই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক নাটক সাজানো হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বানানোর অনেক চেষ্টা হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সচিবালয়ে তাঁর দপ্তরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন বলে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। দুটি খবর পাশাপাশি পড়ার পর ভাবছি, নির্বাচন ঘিরে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানোর রেকর্ড থেকে আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব?
কামাল আহমেদ সাংবাদিক