প্রাথমিক শিক্ষায় অবহেলা যেভাবে বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে

দেশের অবহেলিত শিক্ষা খাতের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত হলো প্রাথমিক শিক্ষা। অথচ পৃথিবীর সব উন্নত দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্তের সন্তানেরা পড়ে না।

বড় শহরের বাবা-মায়েরা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নামকরা স্কুলে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করান এবং মাসে মাসে বড় অঙ্কের ফি দেন। এরপর সেই ছেলেমেয়েদের বড় অংশ দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় বিনা পয়সায় পড়াশোনা করে।

সাবেক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার আহমদ ছফাকে বলেছিলেন, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হলো টপ হেভি (যদ্যপি আমার গুরু)। অর্থাৎ ওপরের দিকটা ভারী, নিচের দিকটা হালকা।

ফলে শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। আবদুর রাজ্জাক আরও বলেছিলেন, এখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত তৈরি হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ের মান দেখে প্রশ্ন জাগে, যে জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক বানায় বা ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে খরচ করে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মার বুকে সেতু বানায়, সেই জাতির পাঠ্যপুস্তকের মান এত নিচু হবে কেন?

১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকস্বল্পতা ও পাঠ্যবইয়ের নিম্নমান দেখে মনে হয়, আবদুর রাজ্জাকের সেই কথার বাস্তবতা এখনো আছে।

বিশেষ করে পাঠ্যবইয়ের মান দেখে প্রশ্ন জাগে, যে জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক বানায় বা ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে খরচ করে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মার বুকে সেতু বানায়, সেই জাতির পাঠ্যপুস্তকের মান এত নিচু হবে কেন?

প্রাথমিক শিক্ষা পিছিয়ে থাকার কারণ নিয়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেনের অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণ আছে। ১৯৭০ সালে ভারতের হায়দরাবাদে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন অমর্ত্য সেন। সেই বক্তৃতার মূল কথা হলো, ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতে উচ্চশিক্ষার দারুণ প্রসার হলেও প্রাথমিক শিক্ষার অতটা হয়নি।

পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি দেখান, প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে ৬০ শতাংশ আর উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে ১২৮ শতাংশ। তিনি এর মধ্যে আশঙ্কার কারণ খুঁজে পান। অনেকে ভাবতে পারেন, স্বাধীনতার পর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে তখন ভারতে বেশি বেশি উচ্চশিক্ষিত মানুষ প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু অমর্ত্য সেন বললেন, না, এর পেছনে ভিন্ন গল্প আছে, যে গল্পটি পরবর্তীকালে তিনি বারবার নিয়ে এসেছেন। সেটা হলো, উচ্চশিক্ষা প্রসারণের পেছনে সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবল চাপ ছিল এবং রাজনীতিকেরা তা উপেক্ষা করতে পারেননি। শিক্ষার অর্থনীতিতে যে বিষয় আলোচিত হয়, তা হলো প্রাথমিক শিক্ষার রিটার্ন বেশি, সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষায় বেশি বিনিয়োগ করা উচিত, উচ্চশিক্ষায় নয়।

কিন্তু ভারতের উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণে সেই যুক্তির লেশমাত্র পাওয়া যাচ্ছে না; বরং যা ঘটেছে, তার কারণ আর্থসামাজিক, অর্থাৎ সেই পরিকাঠামোর বাইরে গিয়ে শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। তিনি বলছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেন, তা বুঝতে আমাদের এই আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক গতি–প্রকৃতি বুঝতে হবে।

অমর্ত্য সেনের এ কথার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের এমএ ও বিএ ডিগ্রি নিয়ে আমোদ-আহ্লাদের সম্পর্ক খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এই মোহ এত প্রবল যে দেশের একটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন একসময় জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের দাবি করত। এখন অবশ্য দেশের প্রায় সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে।

অমর্ত্য সেনের ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেশন’ শীর্ষক বইয়ের একটি অধ্যায়ের নাম ছিল ‘বেসিক এডুকেশন অ্যাজ আ পলিটিক্যাল ইস্যু’।

এরপর ২০১৩ সালে ‘অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন’ শীর্ষক বইয়ে শিক্ষা বিষয়ে তিনি বলেছেন, এখানে একধরনের কেন্দ্রিকতা দরকার।

বারবার তিনি বলেছেন, মৌলিক শিক্ষা রাজনৈতিক ইস্যু। কিছু কিছু জায়গায় যে শিক্ষা রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠেনি তা নয়, যেমন ভারতের কেরালার কথা বলা যায়। ইদানীং দিল্লির কথা বলা যায়, দিল্লির সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষার মান এমন পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে যে সেগুলো এখন বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

ফলে দিল্লির সরকারি স্কুলগুলোর সুনাম বেড়েছে, আম আদমি পার্টি নির্বাচনের সময় তা কাজে লাগাচ্ছে। অর্থাৎ সরকারি স্কুলের উন্নয়নকে তারা নির্বাচনের বিষয়ে পরিণত করতে পেরেছে।

বিষয়টি হলো, আমাদের মতো দেশে এমনিতেই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল, তার মধ্যে আবার যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা, সেটি আরও অবহেলিত। দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই; নেই প্রয়োজনীয় উপকরণ। সেই সঙ্গে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব প্রকট। অথচ দেশে একের পর এক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষা গুরুত্ব পাওয়ার কারণে একটি শ্রেণি সুবিধা পেলেও বড় জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে। সর্বজনীন শিক্ষা বৈষম্য কমায়—এটাই হলো মূল কথা। সর্বজনীন শিক্ষা গুণমানসম্পন্ন হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে, সেখান থেকে সামাজিক বৈষম্য কমে। কিন্তু দেশে প্রাথমিক শিক্ষার মান কী, তা বলাই বাহুল্য। বস্তুত, কোনো শিক্ষার মানই বিশ্বমানের নয়।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা গুণমানসম্পন্ন না হওয়ায় প্রাইভেট টিউশন এখন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রাইভেট টিউশন ছাড়া শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না—এটা এখন স্বতঃসিদ্ধ বিষয়; কেউ তা নিয়ে প্রশ্নও তোলে না। কোচিং সেন্টারে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের ছোটাছুটি দেখে মেন হয়, এরা বোধ হয় বিদ্যালয়ে পড়ে না, কোচিং সেন্টারেই পড়ে। তাহলে বিদ্যালয়ের ভূমিকা কী?

এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রাইভেট টিউশন গভীর বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে যত তত্ত্ব আছে, সব কটি ঘুরেফিরে বৈষম্যের আওতায় চলে যায়।

সর্বজনীন শিক্ষা বৈষম্য কমায়—এটাই আমরা জেনেছি। সর্বজনীন শিক্ষা গুণমানসম্পন্ন হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে, সেখান থেকে সামাজিক বৈষম্য কমে। কিন্তু এখন প্রাইভেট টিউশনের পথ ধরে বৈষম্য বাড়ছে। যারা অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা নিতে পারছে, তারা ভালো করছে; যারা পারছে না, তারা অতটা ভালো করছে না।

ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো উদাহরণ নয়। এ পরিস্থিতিতে ব্রিজিং দ্য গ্যাপ বা ব্যবধান কমানোর বিষয়টি অধরা থেকে যাচ্ছে—আরও সত্যভাষণ হয় যদি বলি, ব্যবধান কমার বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছে।

আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো, মানুষ এখন শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারায় যেকোনোভাবে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। সে জন্য বাবা-মায়েরা খেয়ে না–খেয়ে উঠেপড়ে লেগে যান। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের সামনে অভিভাবকদের জটলা দেখলেই বিষয়টি বোঝা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রতিযোগিতায় সবার পক্ষে শামিল হওয়া সম্ভব নয়। সে জন্য রাষ্ট্রের আরও ভূমিকা প্রয়োজন।

শিক্ষার সর্বজনীনতা ও সমান গুণমান নিশ্চিত করার জন্য বিপুল ব্যয় করা প্রয়োজন। অথচ দেশে শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির অনুপাতে কমছে।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং এর আগের অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ; যদিও বিশ্লেষকেরা বরাবর শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছেন। শিক্ষা খাতে এভাবে বরাদ্দ কমিয়ে আমরা কোনোভাবেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারব না।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন এখন ভালো হলেও বেসরকারি বিদ্যালয়ে বেতন তার সমান নয়। আন্তর্জাতিক স্কুলগুলো বাদে সিংহভাগ বিদ্যালয়েই শিক্ষকদের বেতন কম, যদিও বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন কম নেওয়া হয় না। শানে নজুল হলো, স্বল্প বেতন দিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালো সেবা আশা করা যায় না। সেই সঙ্গে কারিকুলামের সমস্যা তো আছেই।

‘কান্ট্রি অব ফার্স্ট বয়েজ’ শিরোনামের বইয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, যে প্রশ্নটা করা দরকার, তা হলো শিক্ষার অসাম্য কেবল বাদ পড়ে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া মানুষের প্রতি অন্যায় নয়, এর ফলে সামাজিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের অদক্ষতা তৈরি হয়। এই দক্ষতা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য নয়, এই দক্ষতা সামাজিক দক্ষতা।

অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে সমাজ যতটা করতে পারে, তার চেয়ে কম করছে। এটাই সামাজিক অদক্ষতা। ফার্স্ট বয়দের দিকে বেশি মনোযোগের ফলে সমাজের ক্ষতি হচ্ছে। এতে সমাজের গড় মান নিচে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে।

  • প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক