নয়াদিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে এবং দুই পক্ষ তাদের আগের অবস্থানেই রয়েছে বলে জানা গেছে। এ খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি আলোচিত প্রশ্নের প্রথমটি অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লিতে আলোচনা কেন, তা ছাপা হয়েছে গতকাল। অন্য দুটি প্রশ্ন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আগ্রহ-উৎসাহ কখন ও কীভাবে ‘হস্তক্ষেপে’ পরিণত হলো? বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে? এই দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে আজকের শেষ পর্বে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন সামনে রেখে গত দেড় বছরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর একধরনের মেরুকরণ ঘটেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বারবার বলে আসছে যে তারা চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন এ ধরনের বক্তব্যকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বলেই বর্ণনা করেছে এবং তারা যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে, তা নিয়ে রাখঢাক করছে না। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা বাধা দেবে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা দেবে না বলে নীতি ঘোষণা করেছে এবং তার বাস্তবায়নও শুরু করছে।
গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যত প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করেছেন, কিংবা বাংলাদেশ সরকারের যত প্রতিনিধি সরকারিভাবে ওয়াশিংটন সফর করেছেন, তাঁদের আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়েছে আসন্ন নির্বাচন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের সবাই এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বারবার বলছেন যে আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ যে তাতে আস্থা রাখতে পারছে না, তা তাদের কথাতেই সুস্পষ্ট।
এ ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রায়ই এ অভিযোগ করছেন যে বিদেশি শক্তিগুলো, যা আসলে প্রকারান্তরে পশ্চিমা দেশগুলোকে বোঝায়, তারা হস্তক্ষেপ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য এবং পদক্ষেপকে ‘প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ’ বলার ক্ষেত্রে ভারতের গণমাধ্যমের বিশ্লেষকেরা এগিয়ে আছেন।
এটা ধরে নেওয়া যায় যে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গুমের শিকার এক ব্যক্তির বাড়িতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে নতুন করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের আগ্রহ এবং কথিত হস্তক্ষেপের আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা একে ভিয়েনা কনভেনশনের বরখেলাপ বলেও উল্লেখ করেছেন। এ সময়ই যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রাশিয়ার ঢাকা দূতাবাস টুইটারে এবং পরে মস্কোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণের সমালোচনা করা হয়। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণার পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পরোক্ষ সমালোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের ‘পাশে থাকার’ ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৭ জুলাই ২০২৩ সংসদের একটি উপনির্বাচনের পরে ১৩টি দেশের কূটনীতিকেরা বিবৃতি দিলে তাঁদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
এসব ঘটনার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সদস্যরা দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং হোয়াইট হাউসে চিঠি দিয়েছেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটছে ইউরোপেও; ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং কয়েকজন সদস্য আরও কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন।
আর এসব নিয়ে বাংলাদেশের সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেই যাচ্ছেন। একদিকে তাঁরা বলছেন বিদেশিদের কিছুই করার নেই, অন্যদিকে বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সেলফি’তে ‘কেল্লা ফতে’ হয়ে গেছে। কখনো বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। কখনো বলা হচ্ছে, এই নীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।
বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের আগ্রহ এবং সংশ্লিষ্টতার একটা পটভূমি আছে। বিষয়টি এমন নয় যে এই প্রথমবারের মতো বিদেশিরা এসব নিয়ে কথা বলছেন। ১৯৮২ সালে দেশে সেনাশাসন জারির পর রাজনৈতিক দলগুলো যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তাতে দমন–পীড়ন চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নিয়মিতভাবেই বিদেশি কূটনীতিকদের অবহিত করত।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী দলগুলোর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সদস্য স্টিফেন সোলার্জ ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টে এই সংশোধনী যুক্ত করার প্রস্তাব দেন যে বাংলাদেশে মার্কিন সহযোগিতার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হোক। গণতন্ত্রের লক্ষণ হিসেবে যে পাঁচটি কথা বলা হয়েছিল, তার প্রথমটি ছিল বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, ‘যাতে জনগণের মতের প্রতিফলন থাকবে’। এই লক্ষ্যে ১৪ জুলাই ১৯৮৮ কংগ্রেসের শুনানিও হয়েছিল। এ ধরনের উদ্যোগ ইউরোপেও ছিল।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংবিধানে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের সূচনা করলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূচনা হয়। যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা আনিয়াওকু বাংলাদেশে আসেন এবং সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত করেন।
পরে কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান মার্টিন স্টিফেনকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্বও দেওয়া হয়। নিনিয়ান ১৯৯৪ সালের অক্টোবর ঢাকায় আসেন। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা শেষে স্যার নিনিয়ান একটি সমাধান প্রস্তাব হাজির করেছিলেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার থাকার কথা ছিল। আওয়ামী লীগ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় অচলাবস্থার অবসান হয়নি। অনেকের স্মরণে থাকবে, স্যার নিনিয়ানের প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শাহ এ এম এস কিবরিয়া কমনওয়েলথ মহাসচিবের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে স্যার নিনিয়ান ‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন’।
এ রকম পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিভ মেরিল আলোচনার উদ্যোগ নেন। তাঁর সঙ্গে ছয়টি দেশের কূটনীতিকেরা যুক্ত ছিলেন বলে নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে জানা যায়। ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন বিএনপির তত্ত্বাবধানে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ওই সরকারকে স্বীকৃতি না দিতে ‘পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশকে’ আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এ সময়ের স্বল্প আলোচিত কিন্তু সম্ভবত সফল প্রচেষ্টা হচ্ছে মার্কিন কংগ্রেস সদস্য বিল রিচার্ডসনের। মাত্র দুই দিনের সফরে এসে তিনি বলেছিলেন, সংকট সমাধানে তাঁর কাছে সুস্পষ্ট প্রস্তাব আছে। এ প্রস্তাবের বিস্তারিত প্রকাশিত না হলেও তিনি দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেন এবং তাঁর এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতেরা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। সেই আলোচনার সূত্র ধরেই খালেদা জিয়া বিরোধীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন ১৯৯৬ সালের ৩ মার্চ।
বাংলাদেশের জন্য আগামী নির্বাচনের গুরুত্ব কেবল কে ক্ষমতায় থাকবে তা–ই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির প্রশ্ন। অভ্যন্তরীণভাবে একটি কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকা না–থাকার প্রশ্নটি নির্ধারণের বিষয় হয়ে উঠেছে এই নির্বাচনে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তার পথরেখার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
এ প্রস্তাবের ব্যাপারে এ ধরনের গুঞ্জন আছে যে মধ্যস্থতাকারীরা খালেদা জিয়াকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছিলেন যে বিরোধীদের দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করে ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় এবং নির্বাচনের পরে তাঁর বা তাঁর দলের ওপরে অন্যায় নির্যাতন চালানো হলে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হবে।
বিদেশিদের সংযুক্তির আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয় ২০০১ সালের জুলাই মাসে। ছয় দিনের সফরে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। তিনি দুই নেত্রীর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু তাতে দুই পক্ষের ভেতরে আস্থা তৈরি হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ৫০ জন কূটনীতিকের কাছে ৫৫টি অভিযোগ করেছেন বলে ২০০৬ সালের ২১ মার্চ একটি সাপ্তাহিকে খবর বেরিয়েছিল।
২০০৬ সালের শেষ নাগাদ নেওয়া কূটনীতিকদের উদ্যোগ প্রায় সবার জানা ও বহুল আলোচিত। বাংলাদেশের আসন্ন রাজনৈতিক সংকট বিষয়ে উদ্বিগ্ন কূটনীতিকেরা আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে শুরু করেন। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পেট্রিসিয়া বিউটিনেস, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ইউএনডিপির আবাসিক পরিচালক রেনেটা লক ডেসালিয়ন।
লক্ষণীয় অক্টোবর ২০০৬ থেকে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত কূটনীতিকদের এসব উদ্যোগকে কেউই ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করেননি। বরং দুই নেত্রী এবং তাঁদের দলের নেতারা এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ বিষয়ে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের প্রস্তাব। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে হাসিনা একটি চিঠিতে এ অনুরোধ করেছিলেন।
উইকিলিকসের সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ৭ জানুয়ারির এক তারবার্তায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিল যে শেখ হাসিনা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ অধীনে নির্বাচনে তিনি রাজি আছেন। দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে, ১১ জানুয়ারির দুপুরে কূটনীতিকেরা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন কানাডার হাইকমিশনের বাসায়; সেখানেই তাঁরা জানিয়েছিলেন যে তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে ছয়জন কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। রাতেই সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে এ অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপের কারণেই সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল।
সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে যে অধ্যায়ের সূচনা, তার অবসান ঘটে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। আপাতদৃষ্টে এ সময়ে বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল না বলে মনে হলেও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনী কোয়ালিশন ইয়ার্স ১৯৯৬-২০১২ (প্রকাশকাল: ২০১৭) থেকে জানা যায়, তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিপদাপন্ন হবেন না।
শুধু তা–ই নয়, প্রণব মুখার্জি আওয়ামী লীগ নেতাদের এই বলে তিরস্কার করেছিলেন যেন তাঁরা কেন দলের নেত্রী শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। আত্মজীবনীতে দেওয়া এই ভাষ্যে রাজনীতি এবং নির্বাচনে বিদেশি কোনো দেশের যে ভূমিকা তুলে ধরে, এর আগে আর কখনো কোনো দেশ বা তাঁর নেতা এই ভূমিকা রাখেননি। আক্ষরিক অর্থে এটি অভূতপূর্ব।
কিন্তু ২০১৭ সালে ইতিহাসের এই অধ্যায় জানার আগেই বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের অভিজ্ঞতা লাভ করে। ২০১৩ সালের শেষ পর্যায়ে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে নির্বাচন বর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছে, সে সময় ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং। দুই দিনের সফরের সময় সুজাতা সিং জেনারেল এরশাদকে নির্বাচন বর্জনের পথ থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২২ ঘণ্টা অজ্ঞাতবাসে থাকার পর সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেই জেনারেল এরশাদ ঘোষণা দিয়েছিলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে।
এ সময় ভারতের অবস্থানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের ফারাক ছিল। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা ২০১৩ সালে একাধিকবার দিল্লিতে গিয়ে সবার অংশগ্রহণের মতো একটি নির্বাচনের জন্য ভারত যেন অবস্থান নেয়, সেটা বোঝাতে চেষ্টা করে সফল হননি (এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, আলী রীয়াজ, নিখোঁজ গণতন্ত্র, ঢাকা: প্রথমা, ২০২১, পৃষ্ঠা ১৯৭-২০৫)।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেছিলেন, ‘দূতিয়ালি’ করার জন্য তিনি আসেননি, নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারত ‘সর্বোচ্চসংখ্যক’ দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। দূতিয়ালি করার চেষ্টা ছিল জাতিসংঘের। জাতিসংঘের মহাসচিবের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশে ২০১২ সালের ডিসেম্বর, ২০১৩ সালের মে এবং ২০১৩ ডিসেম্বরে ঢাকা সফর করেন। তঁার চেষ্টা সফল হয়নি। অথচ তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, যার নেত্রী ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘের কাছে চিঠি লিখেছিলেন এবং পরে জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহের কথা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছিলেন।
এক বছর ধরে যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের কথা বলে আসছেন এবং এমন কথা বলছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ‘বিএনপির নিরাপত্তা সম্পাদক হয়েছেন’ (বিডিনিউজ ২৪, ৩ নভেম্বর ২০২৩), তাঁরা এ ধরনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ইতিহাসকে বিবেচনার বাইরের রাখেন।
যেটা আরও লক্ষণীয়, ১৯৯৬, ২০০৬ ও ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা বলে যে বাইরের শক্তিগুলোর সংশ্লিষ্টতা থেকে আওয়ামী লীগ বেশি লাভবান হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা থেকে এটাও দেখা যায়, বাইরের শক্তিগুলো নির্বাচন ও রাজনীতিকে তখনই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে, যখন দেশের রাজনীতিকে, বিশেষ করে রাজপথের রাজনীতিকে কোনো দল নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।
অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে যেসব ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীনেরা এমন শিক্ষা নিতে পারেন যে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতা, বিশেষ করে যারা অবাধ নির্বাচনের ওপরে জোর দিয়েছে, তাদের চাপ নির্বাচনের পরে কার্যত তেমন থাকে না। কিন্তু এ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বর্তমান বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশের বর্তমান ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এটা মনে রাখা দরকার যে ২০২৩ সালে বিদেশি শক্তিগুলোর অবস্থান শুধু স্বার্থগত দ্বন্দ্বের বিষয় নয়, এর সঙ্গে আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রশ্নও জড়িত। ফলে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত আলোচনার পর কোনো পক্ষের অবস্থান বদলে যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য শক্তিগুলো সরকারের আশ্বাস এবং ভারতের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে, এমন ভাবলে ভুল হিসাব করা হবে।
বাংলাদেশের জন্য আগামী নির্বাচনের গুরুত্ব কেবল কে ক্ষমতায় থাকবে তা–ই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক রাজনীতির প্রশ্ন। অভ্যন্তরীণভাবে একটি কার্যকর বহুদলীয় ব্যবস্থা থাকা না–থাকার প্রশ্নটি নির্ধারণের বিষয় হয়ে উঠেছে এই নির্বাচনে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, তার পথরেখার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
এগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশের নাগরিকেরাই কেবল উদ্বিগ্ন, তা নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোও চিন্তিত। ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে এবং এর মধ্য দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে বিদেশিদের সংশ্লিষ্টতা ও চাপ দুটিই বাড়তে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের কথা বিবেচনা করলে এ ধরনের পরিস্থিতি সাধারণ নাগরিকদের জন্য একধরনের অশনিসংকেত।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট