ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে

যেখানেই বৈষম্য বাড়ছে, সেখানেই গণতন্ত্র মার খাচ্ছে

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই ডেমোক্র্যাটরা অর্থনীতি নাকি গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচারণায় জোর দিতে হবে, সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।

তবে শিকাগো সেন্টার অন ডেমোক্রেসির অধীনে চালানো আমাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ—এ দুটি বিষয় ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আমরা গবেষণায় দেখেছি, যেখানে উচ্চ মাত্রার আয়বৈষম্য থাকে, সেখানকার গণতন্ত্রের স্বৈরাচারে মোড় নেওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বিচারে যুক্তরাষ্ট্রে এখন খুব বেশি মাত্রায় আর্থিক বৈষম্য দেখা যাচ্ছে এবং এ বৈষম্য সেখানকার গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের জন্য আংশিকভাবে দায়ী।

ট্রাম্প অর্থনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে। অ্যান্টি-এলিটিজম তাঁকে জনতুষ্টিবাদী করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এখন ডেমোক্র্যাটরা যদি ট্রাম্পের সেই অর্থনৈতিক আভিজাত্যবিরোধী ভাবমূর্তিকে ধসিয়ে দিতে পারে এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের আমেরিকানদের জীবনযাত্রার উন্নতি অব্যাহত রাখতে পারে, একমাত্র তাহলেই দেশকে কর্তৃত্ববাদের খাদে পড়া থেকে বাঁচানো যেতে পারে।

এ মুহূর্তে বিশ্বের প্রায় দুই ডজন দেশ ভিন্ন ভিন্ন আদলে গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের মুখে বা গণতান্ত্রিক ধারা থেকে ছিটকে পড়ার মুখে রয়েছে।

এসব দেশে সাধারণত গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হওয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা প্রায়ই সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। তাঁরা সরকারি কর্মচারী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অপমান করছেন এবং ভোটে হেরে গেলে নির্বাচনের বৈধতা অস্বীকার করে বসছেন।

বিশ্বব্যাপী গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে গণতন্ত্র সম্পর্কে চমকে দেওয়ার মতো যে বিষয়টি আমরা পেয়েছি, তা হলো: যে সমাজে আয় ও সম্পদের মালিকানা নিয়ে যত বেশি বৈষম্য থাকবে, সে সমাজে গণতন্ত্র তত বেশি পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে।

গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়ার পেছনে জাতীয় আয়ের (মাথাপিছু জিডিপি) ছোটখাটো প্রভাব থাকলেও গণতন্ত্রের বয়স এবং এর সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার কোনো স্পষ্ট প্রভাব থাকেই না বলা যায়। আদতে গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়ার মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বৈষম্য।

যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা অসাম্যের সমাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলোতে ন্যায্য অর্থনীতিকে উৎসাহিত করা দরকার। সেটি করতে পারলেই সেসব জায়গার গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে পারবে।

উদাহরণস্বরূপ, একটা হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে ৮৭ শতাংশ গণতান্ত্রিক দেশে যে আর্থিক সাম্য ছিল, সুইডেনে তার চেয়ে সাম্য বেশি ছিল এবং দেশটিতে গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।

অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে আর্থিক বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র ভেঙে পড়ার ঝুঁকি ছিল ৩০ শতাংশ। ওই সময় বিশ্বের ৬০ শতাংশ গণতান্ত্রিক দেশে যতটুকু অসাম্য ছিল, তার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি অসাম্য ছিল (যদিও ওই সময় সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের দিকে কিছুটা আশাব্যঞ্জকভাবে সম্পদ পৌঁছাচ্ছিল)। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য ঝুঁকি ছিল ৯ শতাংশ, যা সুইডেনের ঝুঁকির দ্বিগুণের বেশি।

অর্থনৈতিক বৈষম্য গণতন্ত্রকে কীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত করে ফেলে, তা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও সুইডেনের মধ্যকার এ পার্থক্যগুলো ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।

লক্ষ করার বিষয় হলো, দুটো দেশেই একটি করে বড় ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দল রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ) স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডানপন্থী রিপাবলিকান পার্টি। সুইডেনে ঠিক একই ধরনের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের দল হলো দ্য সুইডেন ডেমোক্র্যাটস। ট্রাম্পের অনুসারীদের মতো সুইডেনের এই দল দুই দশক ধরে অভিবাসনের ক্ষেত্রে দেশটির তুলনামূলক উন্মুক্ততা নীতির বিরোধিতা করে এসেছে এবং তার সুবাদে তারা বেশ জনসমর্থন পেয়েছে।

২০২২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ডানপন্থী দলটি ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল দলগুলোকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে এবং এরপর থেকে তারা মধ্য ডানপন্থী শাসক জোটের শরিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

তবে ডানপন্থী এই দল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হওয়ার পরও সুইডেনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ের ব্যাপারটা ক্রমবর্ধমানভাবে ফুটে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুইডেনের রাজনীতিবিদেরা সংবাদমাধ্যমকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে খোঁচা মারেন না, বিচারক ও কৌঁসুলিদের আক্রমণ করেন না, সরকারি কর্মচারীদের ‘শুদ্ধ করার’ হুমকি দেন না বা নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না।

সম্ভবত এ ধরনের অসদাচরণ সুইডিশ জনসাধারণের কাছে ব্যাপকভাবে পাত্তা পাবে না। কারণ, সেখানকার মানুষের আর্থিক ব্যবধান তুলনামূলকভাবে খুবই কম। আর যেখানে আয়বৈষম্য কম থাকে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থাও তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে।

সুইডেনের লোকেরা তাদের দেশের উদার কল্যাণ রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে উপকৃত হয়েছে। সুইডেন ডেমোক্র্যাটরা জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতে সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধির জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ইউরোপের জাতীয়তাবাদী ডানপন্থীরা ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল দলগুলোর চেয়ে সামাজিক নীতির পক্ষে বেশি সমর্থন প্রকাশ করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের হবু স্বৈরাচারী ট্রাম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বান্তঃকরণ সমর্থনের ওপরে দাঁড়ানো নয়। অর্থাৎ রিপাবলিকান সমর্থকেরা তাঁকে সন্দেহের মধ্যে রেখেই সমর্থন দিয়ে থাকে।

ট্রাম্প নিজে যদিও সহকর্মী রিপাবলিকানদের সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক খাতে (সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যান্ড মেডিকেয়ার) ব্যয় কমানোর বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন, তথাপি তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চালু করা ওবামাকেয়ার বাতিল করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি।

আরও খারাপ, ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার প্রশাসন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে আয় এবং সম্পদের ব্যবধান বাড়াবে। কারণ, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প করছাড় অনুমোদন করেছিলেন এবং তিনি যদি আবার প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে সেই করছাড় আরও বাড়াবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি তিনি আয়কর সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার এবং আয়কর ছাড়ে সৃষ্ট ঘাটতি আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও করেছেন। এ প্রতিশ্রুতি হয়তো তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আনতে পারে।

একজন বক্তৃতাবাজ নেতা হিসেবে ট্রাম্প তাঁর ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য অভিজাতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে থাকেন। গণতন্ত্রকে দুর্বল করতে এসব বক্তব্য ভূমিকা রাখছে।

একটি বিষয় স্পষ্ট যে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে এবং তার জের ধরে সেখানকার গণতন্ত্র আরও বেশি হুমকির মুখে পড়ে যাবে।

যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা অসাম্যের সমাজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশগুলোতে ন্যায্য অর্থনীতিকে উৎসাহিত করা দরকার। সেটি করতে পারলেই সেসব জায়গার গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে পারবে।

● সুসান স্টোকস শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং শিকাগো সেন্টার অন ডেমোক্রেসির ফ্যাকাল্টি ডিরেক্টর

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ