আপনাকে দেখেই কিন্তু শিখছে আপনার শিশু

প্রথিতযশা নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিডকে একবার শিক্ষার্থীরা জিজ্ঞাসা করেন, মানুষের সাংস্কৃতিকভাবে সভ্য হয়ে ওঠার প্রথম নিদর্শন কোনটি?

খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর হিসেবে শিক্ষার্থীরা আসবাব বা শিকারের যন্ত্রপাতি অথবা অন্য কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা ভাবছিলেন।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের অবাক করে দিয়ে মিড জানান, সাংস্কৃতিক সভ্যতার প্রথম নিদর্শন আসলে সুস্থ হয়ে ওঠা একটি ঊরুর হাড়।

কোমর থেকে হাঁটু অবধি মানব শরীরের সবচেয়ে বড় হাড়টি একবার কোনো কারণে ভাঙলে প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ হতে কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ লাগে।

প্রাচীন সমাজে একবার এই হাড় ভেঙে যাওয়ার মানে ছিল চলাচলের ক্ষমতা একেবারেই হারিয়ে ফেলা; আর শিকারি কোনো প্রাণীর শিকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা।

নৃবিজ্ঞানী মিড শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘আজ থেকে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে পাওয়া সুস্থ হয়ে ওঠা ঊরুর হাড়টি থেকে আমরা বুঝতে পারি, কেউ একজন এই অসুস্থ সঙ্গীকে বন্য প্রাণীর শিকার হওয়ার জন্য পেছনে ফেলে যায়নি। বরং তার সঙ্গে থেকে নিরাপত্তা দিয়েছে; তার জন্য আশ্রয়, খাবার ও পানির ব্যবস্থা করেছে এবং কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে তাকে সঙ্গে বহন করে নিয়ে গেছে।’

পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার এই সম্পর্কই মানবজাতিকে প্রাচীন সমাজের বিপৎসংকুল পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। আর আধুনিক মানবসভ্যতা গড়ে ওঠার ভিত্তিই হচ্ছে মানবিক এই মূল্যবোধ।

পাশাপাশি এটাও স্বীকার করে নিতে হবে যে মানবিক মূল্যবোধের সবকিছুই মানবশিশু জন্ম থেকে নিয়ে আসে না। এর অনেক কিছুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখে নিতে হয়। আর শিশুর শিক্ষাগ্রহণ যেহেতু পরিবার থেকে শুরু হয়, তাই পরিবারই হচ্ছে শিশুর মূল্যবোধ তৈরির প্রথম জায়গা।

আমাদের শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। এ কারণে পরিবারের বড়রা যা বলেন, যা করেন, তা-ই দেখে দেখে সেই অনুযায়ী শেখে তারা। তাই পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক কোনো কথা, কাজ, আচরণ বা অভ্যাস শিশুদের মধ্যে মূল্যবোধ হিসেবে খুব ছোটবেলাতেই বিকশিত হতে পারে।

টিস্যু বা চিপসের প্যাকেট রাস্তায় না ফেলে জায়গামতো ফেলা, বড়দের সম্মান করা, ভালো কথা বা কাজকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করা অথবা কারও কাছ থেকে সহায়তা পেলে তাকে ধন্যবাদ জানানোর মতো ছোটখাটো কিন্তু সুদূরপ্রসারী বিষয় শৈশবে খুব সহজেই শিখিয়ে ফেলা যায়। আর ছোটবেলায় একবার অভ্যাস হয়ে গেলে বড় হওয়ার পরও এসব মূল্যবোধ তাদের মধ্যে বজায় থাকে।

শিশুদের মূল্যবোধের বিকাশে পরিবারের পরপরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। তিনি একজন শিশুর ভাবনার জগৎকে আলোড়িত করতে পারেন, কোনো তথ্য মুখস্থ না করিয়ে নতুন নতুন বিষয় শেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন, প্রতিদিন কীভাবে নতুন চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়, তা শেখাতে পারেন।

শিক্ষকেরা একদিকে পাঠ্যক্রমের ভেতরে থাকা সাহিত্য, বিজ্ঞান বা ইতিহাসের মতো বিষয়গুলো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। আবার অন্যদিকে খেলাধুলা, বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি বা অভিনয়ের মতো পাঠ্যক্রমবহির্ভূত নানান কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনমুখী মূল্যবোধ তৈরি করতে পারেন।

একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে হলে তার মধ্যে সব ধরনের মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত ও শারীরিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, মানসিক ও আবেগীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ। একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের কোনো না কোনো সময় এসব মূল্যবোধের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়। একজন শিক্ষক শৈশবেই একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে সহযোগিতা, একতাবোধ, উদারতা, মমত্ববোধ, নেতৃত্ব ও সহানুভূতির মতো ইতিবাচক গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে পারেন।

শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও আবেগীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের বেশ কিছু স্কুলে ইতিমধ্যে এসইএল (সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশনাল লার্নিং) চালু করা হয়েছে। এতে করে নিয়মিত ক্লাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা মানসিক ও নৈতিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতার ওপর ভিত্তি করেই মানুষের সমাজ পরিচালিত হয়। আর আজকের শিশুই ভবিষ্যতে সমাজে নানাভাবে অবদান রাখবে। তাই শৈশবেই তাদের মধ্যে মূল্যবোধ বিকশিত করার সুযোগ তৈরি করা, সমাজের টিকে থাকা ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি।

  • সুমনা করিম ভাইস প্রিন্সিপাল, ডিপিএস (দিল্লি পাবলিক স্কুল) এসটিএস জুনিয়র স্কুল