দুই বাসের প্রতিযোগিতায় হাত ছিঁড়ে যাওয়া রাজীব হোসেনের কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে থেকে শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন তিনি। এতিম ছোট দুই ভাইকে নিয়ে থেমে গেল তাঁর জীবনসংগ্রাম। আমরা জানি না, তাঁর সেই দুই ভাই কোথায় আছে।
রাজীবের সেই ছেঁড়া হাতের ছবি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে। প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান মুঠোফোনে তুলেছিলেন সেই ছবি। ২০১৮ সাল, কর্মসূত্রে আমি তখন ঢাকায় থাকি। পত্রিকায় সেই ছবি দেখে আমার মা উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন দিয়েছিলেন। আহা, মায়ের মন। দূরে থাকা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে যিনি সদা অস্থির থাকেন।
আমার মায়ের মতোই একজন জাহানারা বেগম। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ সাইফুল আলম আমার বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। একই কক্ষে একই বেঞ্চে বসে আমরা ক্লাস করেছি, পরীক্ষাও দিয়েছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ৯-১০ কিলোমিটার দূরে খন্দকিয়ার বাসিন্দা সে। ক্যাম্পাস ও বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়, বড়জোর ৪০-৫০ মিনিটের দূরত্বে নাজিরহাটে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের একটি শাখায় কর্মরত ছিল সে। দেড় বছরও হয়নি ব্যাংকে যোগদান করেছে।
বিয়ের জন্য পাত্রীও খোঁজা হচ্ছিল। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সেসহ তিনজনই কর্মজীবী ছিল। তাদের সুখের সংসারে দুঃস্বপ্ন নেমে এল। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ব্যাংক থেকে ঘরে ফিরতে গিয়ে হাটহাজারী পৌরসভায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় সে। স্থানীয় বাসিন্দারা রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনতে আনতে পথেই প্রাণ উবে যায়। বন্ধুদের মেসেঞ্জার গ্রুপে দেওয়া সাইফুলের থেঁতলে যাওয়া মুখের ছবি দেখার সাহস হয়নি।
বন্ধু সাইফুল মারা যায় ১৬ নভেম্বর। তার সপ্তাহখানেক আগে হাটহাজারীতে একই সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক পরিবারের সাতজন নিহত হন। এর এক দিন পরই একই সড়ক দিয়ে একই ধরনের সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে যাতায়াত করছিলাম। চালক আগের দিনের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অটোরিকশা ও বাস দেখিয়ে দিলেন।
রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো। এ মাসের মাঝামাঝি নাজিরহাট এলাকাতেই এক সড়কে স্কুলের গেটে ঢোকার সময় চাঁদের গাড়ির চাপায় মারা যায় তৃতীয় শ্রেণির এক শিশু। তার বাবা একজন মাদ্রাসাশিক্ষক ও মসজিদের ইমাম। জীবনে অনেক মানুষের জানাজা পড়িয়েছেন তিনি। সেই বাবাকে নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি এস এম ইউসুফ উদ্দিনের প্রতিবেদন ছাপানো হলো, ‘জীবনে অনেক জানাজা পড়াইছি, মেয়ের জানাজা পড়াইতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নাই।’ শিশুসন্তান হারানো একজন বাবার এই যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ কীভাবে সহ্য করা যায়। কিন্তু আমরা সহ্য করে যাই।
যখন সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য শুধু জনগণের অসচেতনতাকেই দায়ী করা হয়, তখনই বোঝা যায় স্রেফ সদিচ্ছা না থাকার কারণেই রোধ হচ্ছে না ভয়াবহ এই ‘মহামারি’। আইন তৈরি করা হয় ঠিকই কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে পরিবহনমালিকদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। আমরা জানি না, আর কত নারী বিধবা হলে বা সন্তানহারা হলে আর কত শিশু এতিম হলে তাদের বোধোদয় হবে?
হাটহাজারীতে গোটা একটি পরিবারের প্রাণহানির দিন রাতে রাজধানী ঢাকায় দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় মারা যান মোটরসাইকেল আরোহী দুজন বন্ধু। ঢাকায় যে এলাকায় আমি থাকি, সেই ইস্কাটন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরদিন যে স্কুল মাঠে জানাজা হলো, তার সামনে দিয়েই আমার হাঁটাচলা।
দুই বন্ধু হলেন আরিফুল ইসলাম ও সৌভিক করিম। আরিফুল ইসলাম গণসংহতি আন্দোলনের নেতা আর সৌভিক ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেতা। তারুণ্যের রাজনীতিতে সুপরিচিত মুখ ছিলেন এই দুজন। একটা সুন্দর ও বৈষম্যহীন দেশ-সমাজ গড়ার যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা, অসংখ্য তরুণকেও সেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এমন স্বপ্নবান তরুণদের কেড়ে নেয় দানব ট্রাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের নিয়ে শোক ও কান্নার পাহাড় জমে। আরিফের শিশুসন্তানের নির্বাক চেহারা আমাদের আরও বেশি বাক্রুদ্ধ করে দেয়।
গত শনিবার আরিফ ও সৌভিককে নিয়ে এক শোকসভায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা বরাবরের মতোই শুনলাম, এ মৃত্যু কাঠামোগত হত্যার বড় উদাহরণ। প্রতি মাসে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন থেকে সড়কে মৃত্যুর পরিসংখ্যানের ই–মেইল পাই। সত্যি বলতে, মৃত্যুর এই পরিসংখ্যানে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশে গত এক যুগে সড়ক যোগাযোগে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। দেশজুড়ে সড়ক যোগাযোগে অনেকগুলো মেগা প্রকল্পও হয়েছে। মানুষের যোগাযোগব্যবস্থা যতটা সহজ হয়েছে, সড়কে মৃত্যুও যেন ততটা ‘সহজ’ হয়ে গেছে। নিরাপদ যাতায়াতের নিশ্চয়তাই যদি না পাওয়া যায়, শত বা হাজার কোটি টাকা খরচ করে চোখধাঁধানো সড়ক নির্মাণের কী যথার্থতা থাকে?
সড়কে এ বিশৃঙ্খলা না থামার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অতিরিক্ত গতি, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও সড়ক, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পরিবহন সংগঠন ও পুলিশের চাঁদাবাজি এবং জনগণের অসচেতনতা ও আইন না মানা।
যুগের পর যুগ ধরে কেন এসব সমস্যার সমাধান হয় না। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দু–দুবার আন্দোলনের পরও কেন বেহুঁশ থাকে রাষ্ট্র বা সরকার। যখন সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য শুধু জনগণের অসচেতনতাকেই দায়ী করা হয়, তখনই বোঝা যায় স্রেফ সদিচ্ছা না থাকার কারণেই রোধ হচ্ছে না ভয়াবহ এই ‘মহামারি’। আইন তৈরি করা হয় ঠিকই কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে পরিবহনমালিকদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। আমরা জানি না, আর কত নারী বিধবা হলে বা সন্তানহারা হলে আর কত শিশু এতিম হলে তাদের বোধোদয় হবে?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com