গল্পের নীলমণিরা বাস্তবেও ঘুরে বেড়ান!

সাড়ে তিন দশক একই এলাকায়। ছোট থেকে বড়, প্রায় সবারই তাই মুখচেনা; তাঁর পেশাও অজানা নয় কারও। হাতে থাকা জুতা পলিশ ও সেলাইয়ের সরঞ্জামে ভরা বিশেষ আকৃতি কাঠের বাক্সই তাঁর পরিচয় জানান দেয়, আলাদা করে না বলে দিলেও চলে। তবে তাঁর নাম জানেন হাতে গোনা লোকজন। যদিও সে নামটি ‘ভুল’।

তাঁর দাদি কী জানি কী বুঝে নাম রেখেছিলেন নির্ধন, নির্ধন ঋষি। বাংলা অভিধানে পাতা উল্টে দেখা যাচ্ছে, নির্ধন মানে ধনহীন, দরিদ্র, বিত্তহীন, গরিব। নামকরণের সার্থকতাবিষয়ক একধরনের প্রশ্নের উত্তর নিম্ন মাধ্যমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষায় থাকে। যেমন অমুক কবিতার নামকরণের সার্থকতা লেখ। নির্ধন ঋষির নামকরণ যে সর্বার্থেই সার্থক, পরীক্ষার সেই প্রশ্নের যথার্থতাই যেন নতুন করে তুলে ধরে। জন্মের পর থেকেই গরিবি দেখেছেন, এখনো গরিবিতেই বসবাস। নির্ধন ঋষির ৫০ ছুঁই ছুঁই জীবনেও এসেও তাঁর নামকরণের সার্থকতা এতটুকু হেরফের হয়নি!

তাই রাজধানীর জিগাতলার এলাকার লোকজন যে তাঁকে ‘নির্দাস’ বলে ডাকেন, তা যেন এক অর্থে পরোক্ষে গরিবিকেই অস্বীকারের নামান্তর। যদিও এতে বাস্তবতার ভার ও ধার কোনোটাই এতটুকু কমে না, যা নির্ধনকেই বইতে হচ্ছে, সইতে হচ্ছে। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া নির্ধনের ভাষ্য, তাঁর নামটা হয়তো একটু কঠিন, তাই লোকজন নির্দাস বলে ডাকে!

নামের অর্থ জানেন? একটু লজ্জার হাসি হেসে মাথা নাড়েন দুদিকে। এতগুলো বছর নামের অর্থ না জেনেও যে ‘সার্থক’ জীবন তিনি কাটিয়ে দিলেন, এখন তার অর্থ জানানো বা না-জানানোয় আর কী-বা যায় আসে! বরং অর্থ জেনে মনের ভেতর একধরনের দুঃখবোধ তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মনে এ কথা আসতেই পারে, বিধির কী লীলা, জীবনভর ধনের দেখা পাব না বলেই বুঝি নাম তাঁর ‘নির্ধন’!

নির্ধনের এ কথা শুনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পের নীলমণির কথা মনে পড়ে। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে তাদের ঝাঁজরা চালা দিয়ে ঘরের এখানে-সেখানে পানি পড়ছে। নারিকেল আর তালপাতা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভিজতে হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যে নীলমণি তামাক সেজে দিতে বললে মেয়ে শ্যামা জানায়, তামাক আর একটুখানি আছে।

নির্ধনের বাবার নাম শুনলে অবশ্য নামকরণের সার্থকতা পরিহাসের মতো ঠেকে! দুই বেলা দুই মুঠো ভাতের জোগানের জন্য সারা জীবন যুঝে যাওয়া মানুষটির নাম ছিল ধনেন্দ্র ঋষি। মূলত বেত-বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি-মোড়া বানানো ছিল তাঁর পেশা। অভাবের কারণেই ছেলে নির্ধনকে কিশোর বয়সে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন।

নির্ধনের ভাষ্যমতে, তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের দুই বছর আগে ঢাকায় পা রাখেন তিনি। শুরুতে পুরান ঢাকার একটি জুতা তৈরির কারখানায় কাজ নেন। কিন্তু বেতন-ভাতা ঠিকঠাক পেতেন না। তত দিনে জুতার কাজ টুকটাক শিখে ফেলেছেন। পরে নিজেই জুতা সেলাই ও পলিশ করার কাজ শুরু করেন। বেঁচে থাকার তাগিদে সময়ের ফেরে পড়ে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে মুচি হন। এখনো সেই কাজ করে চলেছেন। এবং অভাব এখনো ছায়ার মতোই লেগে আছে তাঁর জীবনে!

নির্ধন ঋষির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কামারগাঁওয়ে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলেটি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ক্ষান্ত দিয়েছে। পরে মামার সঙ্গে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছেন; সেখানে এক দোকানে কাজ করছে। পরের ছেলেটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট মেয়েটির হাতেখড়ি হচ্ছে। পরিবার দেশের বাড়িতেই থাকে। নির্ধন থাকেন লালবাগ এলাকায়। সেখান থেকে প্রতিদিন হেঁটে জিগাতলায় আসেন। এলাকায় এক বাসার নিচতলায় তাঁর জীবনধারণের ‘উপায়’ বাক্সটি রাখার বন্দোবস্ত আছে। সেখান থেকে বাক্সটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সারা দিন কাজ করেন।

নির্ধন আয়রোজগারের যা হিসাব দিলেন, তা কর্তৃপক্ষের দেওয়া কাগুজে সব হিসাব খারিজ করে দেয়! তাঁর ভাষ্যমতে, মাসে গড়ে আয় তাঁর ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার বেশি নয়। বাসাভাড়া (একসঙ্গে কয়েকজন থাকেন) দেন চার হাজার টাকা। রাতে এক বাসা থেকে খাবার দিয়ে যায়, প্রতিদিন ৮০ টাকা। সকালে চা-বিস্কুট দিয়ে নাশতা সারেন। দুপুরে সব দিন খাওয়া হয় না; যেদিন আয় একটু বেশি হয়, সেদিন হোটেলে খান।

নির্ধনের এ কথা শুনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পের নীলমণির কথা মনে পড়ে। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে তাদের ঝাঁজরা চালা দিয়ে ঘরের এখানে-সেখানে পানি পড়ছে। নারিকেল আর তালপাতা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভিজতে হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যে নীলমণি তামাক সেজে দিতে বললে মেয়ে শ্যামা জানায়, তামাক আর একটুখানি আছে। ‘এত বড় দুঃসংবাদ প্রদানকারিণীকে একটি গাল দিবার ইচ্ছা নীলমণিকে অতি কষ্টে চাপিয়া যাইতে হইল। নীলমণি ভাবিল: বিনা তামাকে এই গভীর রাত্রির লড়াই জিতিব কেমন করিয়া? ছেলের কান্না দুই কানে তীরের ফলার মতো বিঁধিয়া চলিবে, মেয়েটির মুখের চাহনি লঙ্কাবাটার মতো সারাক্ষণ মুখে লাগিয়া থাকিবে, নিমুনিয়ার সঙ্গে নিভার (স্ত্রী) ব্যাকুল কলহ চাহিয়া দেখিতে দেখিতে শিহরিয়া শিহরিয়া মনে হইবে বাঁচিয়া থাকাটা শুধু আজ এবং কাল নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন—  ... প্রশ্ন করা অনর্থক, জবাব সে পরশু হইতে নিজেই সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে—পয়সা নাই।’

বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠাতে পারেন না, নির্ধন প্রতিদিন দুপুরের খাবার খাবেন কী করে! নির্ধনের কি কখনো নীলমণির মতো মনে হয়, ‘বাঁচিয়া থাকাটা শুধু আজ এবং কাল নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন!’

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
    hello.hasanimam@gmail.com