মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে জেদ বা আবেগ নয়, প্রয়োজন সুবিবেচনা

বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কথা আমরা বলে থাকি। এর মধ্যেও জনগণের দাবিতে সরকার অল্প কিছু ক্ষেত্রে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছিল। যেমন সড়ক আইনের কিছু সংস্কার হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভ্যাট আদায় বাতিল হয়েছিল এবং সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল।

তবে এই পদক্ষেপগুলো অকেজো বা নাকচ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বর্তমানে। সড়ক আইনের শক্ত বিধান শিথিল করা হয়েছে, উচ্চ আদালত ভ্যাট প্রত্যাহার ঘোষণা বাতিল করেছেন, সবশেষে কয়েক দিন আগে উচ্চ আদালত সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন।

উচ্চ আদালতের শেষোক্ত রায় নিয়ে ইতিমধ্যে সমাজে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে এর প্রতিবাদে মিটিং–মিছিল হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবে, এমন প্রত্যাশাও ব্যক্ত করছেন কেউ কেউ।

আমি নিজে কোটাব্যবস্থা নিয়ে কিছু লেখালেখি করেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এর স্টেকহোল্ডারদের মনোভাবও জানা আছে। আমার মতে, কোটাব্যবস্থা চালু করা, এটি সম্প্রসারিত করা এবং আন্দোলনের মুখে এটি একেবারে বাদ দেওয়াসংক্রান্ত অতীতের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ছিল আবেগতাড়িত ও একতরফা। কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা, এর মাত্রা, এর সুবিধাভোগী কারা হওয়া উচিত, তা নিয়ে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারকে এখন শক্তভাবে আপিল করতে হবে। কোটা পুনর্বহাল করার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সাংবিধানিক নীতি, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিতে হবে।

২.

আমাদের প্রথমেই মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে সাম্য, সুযোগের সমতা ও বৈষম্যহীনতা। সমতার নীতি কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অনুমোদন করে প্রায়োগিক সমতা নিশ্চিত করার স্বার্থে। সমতার এই দর্শনের বিভিন্ন প্রকাশ আমাদের সংবিধানেও রয়েছে। যেমন সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশ যাতে সরকারি চাকরিতে ‘উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব’ লাভ করতে পারে, সে জন্য ‘বিশেষ বিধান’ প্রণয়ন করা যাবে। এই বিধান বলে নাগরিকদের ‘অনগ্রসর’ অংশের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার বিধান করা অসাংবিধানিক হবে না।

কোটা বিষয়ে সমাজে তীব্র অসন্তোষ শুরু হয় কারা এই অনগ্রসর শ্রেণি এবং উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব মানে কী এসব প্রশ্নে। কোটা নিয়ে অতীত ও বিদ্যমান এই বিতর্ক মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের (এমনকি তাঁদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের) জন্য কোটার বিধানকেন্দ্রিক। মুক্তিযোদ্ধারা কি সমাজের অনগ্রসর অংশ?

এ দেশের তৎকালীন এলিট পরিবারগুলোসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। তাঁরা ঢালাওভাবে অনগ্রসর হন কীভাবে? বা তাঁরা কতটুকু সুবিধা পেতে পারেন?

১৯৭২ সালে গণপরিষদে সংবিধান নিয়ে বিতর্ককালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদান, অবদান ও প্রত্যাশা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের অনগ্রসর বলা হয়নি বা তাঁদের জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থার দাবি করা হয়নি।

তবে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান প্রসঙ্গে পঙ্গু ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় (বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৪৭০-১)। উদারভাবে ব্যাখ্যা করে আমরা তাই হয়তো সঠিক তালিকার ভিত্তিতে শুধু পঙ্গু ও নিহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার কথা ভাবতে পারি। উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে তাঁদের জন্য ৫ শতাংশের মতো কোটা তাই রাখা যেতে পারে।

অন্যান্য কোটার মধ্যে জেলা কোটা সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদের (যেখানে জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে) পরিপন্থী। প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষায় নারীদের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে নারী কোটার প্রাসঙ্গিকতা আগের চেয়ে অনেক হ্রাস পেয়েছে। তবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সীমিত কোটার প্রয়োজন এখনো রয়েছে।

৩.

কোটা প্রসঙ্গে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রবর্তনের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একে সম্পর্কিত করা হয়নি। সে সময়ে ১৯৭২ সালে প্রণীত ইন্টেরিম (বা অন্তর্বর্তীকালীন) রিক্রুটমেন্ট পলিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটার কথা বলা হয়।

এটি ইন্টেরিম বলার মানেই হচ্ছে কোটা স্বল্প সময়ের জন্য প্রযোজ্য রাখার চিন্তা ছিল তখন। ১৯৭৩ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে ৩৫০টি পদে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগের পর এই সুযোগ সম্প্রসারণের কোনো যুক্তি ছিল না।

১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের একজন বাদে বাকি সব সদস্য তাই সরকারি নিয়োগে কোটাব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন প্রচলিত কোটাসমূহ বহাল রেখে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন।

অথচ ১৯৯৭ সালেই এই কোটাব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের ও পরে তাঁদের নাতিদের এর আওতাভুক্ত করা হয় এবং তাঁদের পাওয়া না গেলে তাঁদের জন্য নির্ধারিত পদগুলো শূন্য রাখার নীতি গৃহীত হয়। এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ মারাত্মকভাবে সংকুচিত করা হয় কোটাধারীদের স্বার্থে।

কোটা নিয়ে আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এর মাত্রা। সর্বশেষ ব্যবস্থায় কোটার ভিত্তিতে ৫৬ শতাংশ এবং মেধার ভিত্তিতে মাত্র ৪৪ শতাংশ নিয়োগের বিধান ছিল। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান রেগুলেটরি কমিশনের প্রধান হিসেবে ২০০৮ সালের মার্চ মাসে কোটাব্যবস্থা নিয়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছিলেন।

এই গবেষণার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে (তখনকার হিসাবে) নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান বৈষম্যহীনতার কথা বলেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যতিক্রম হিসেবে (যেমন সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য) কোটাকে অনুমোদন করেছে। ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনো সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।

কোটার এই আধিক্য সমাজে সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ ২০০৬ সালে সম্পন্ন হওয়া ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন প্রথম ২২৮ জন। বাকিদের অযোগ্য ঘোষণা করে চাকরি দেওয়া হয়নি। অপর দিকে বিভিন্ন কোটার কল্যাণে ১৬১১তম হয়ে পররাষ্ট্র, ৫১০৪তম হয়ে প্রশাসন, ৫৩৭৭তম হয়ে কেউ কেউ পুলিশ ক্যাডারে চাকরি পেয়েছিলেন।

আরেকটি বিস্ময়কর বিষয় হলো, এত ব্যাপক হারে কোটা যাঁদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছিল, তাঁরা কোটার সমসংখ্যক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় পাসও করেননি কখনো। এ কারণে ২৮তম থেকে ৩১তম বিসিএসে ৩ হাজার ১৬২টি পদ শূন্য ছিল। অথচ সম্মিলিত মেধাতালিকায় ওপরের দিকে অবস্থান করেও অনেকে চাকরি পাননি।

৪.

কোটাব্যবস্থা পুনরায় চালুর বিবেচনা করতে গেলে সরকারকে অবশ্যই এই নৈরাজ্যকর চিত্রগুলো ভাবতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে যাঁরা বা যাঁদের সন্তানেরা চাকরিতে ঢুকেছেন, তাঁদের সবাইকে চিহ্নিত করে বরখাস্ত করতে হবে। সরকারি চাকরির নিয়োগে সব ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কঠোরভাবে দূর করতে হবে।

এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমান বাস্তবতায় কোটাধারীর মোট সংখ্যা ১০ বা ১৫ শতাংশের মতো করলে এবং পদ শূন্য রাখার বিধান বাতিল করলে কোটাব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য ও সুফলপ্রদ করা যাবে। এ নিয়ে সমাজে তীব্র অসন্তোষও অনেকাংশে দূর হবে।

কোটা নিয়ে কোনো পক্ষের জেদ বা আবেগ নয়, প্রয়োজন সুবিবেচনা।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক