বাজেটের মৌসুমে জাতি রাজনীতিতে মগ্ন। সম্ভবত সবাই একমত—রাজনীতির গতিপথ অর্থনৈতিক ফলাফল নির্ধারণ করে। তাঁরা জানেন, বাজেট একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং বাজেট প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক মীমাংসার ধারাবাহিকতা দ্বারা নির্ণীত হয়। বাজেটপ্রণেতাদের উদ্দেশে জনমনে আলোচিত তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো।
সাম্প্রতিক সময়ে সব ধরনের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ নাকাল। শুধু খাবার নয়; তেল, সাবান, জামাকাপড়, শিক্ষা উপকরণ, পরিবহন—সবকিছুরই দাম বাড়তি। স্বল্প এবং সীমিত আয়ের বন্ধনীভুক্ত দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভরণপোষণে কাঁচি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
সরকার বলেছিল, কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পটভূমিতে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দাম ‘সমন্বয়’ করতে হচ্ছে এবং পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হলে সংশোধন করা হবে। আগস্টে সরকার একলাফে জ্বালানি তেলের দাম ক্ষেত্রভেদে ৪২ দশমিক ৫ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ায়।
তেলের দাম দীর্ঘদিন ধরে ৭০ থেকে ৮০ ডলার হলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্য, তথা সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, আটা, গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ইত্যাদির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও ভোক্তাদের স্বস্তি নেই। এ ছাড়া তাঁরা শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে জিম্মি।
যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে কর বাড়ানো হয়, তাহলে ইতিমধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটে জর্জরিত সাধারণ মানুষ কীভাবে বাড়তি দামের বোঝা বহন করবে? করজাল বাড়ানো এবং আয়করের ফাঁকগুলো কমানোর পরিবর্তে বাসনপত্র, টিস্যু, কলম, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার্যের ওপর উচ্চ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ধার্য করলে বেশির ভাগ মানুষ কীভাবে ন্যূনতম বেঁচে থাকা বজায় রাখবে? অধিকাংশ মানুষ খাদ্য, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের খরচ কমিয়েছে; খাদ্যপণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়লে জীবনযাত্রা নির্বাহ আরও কষ্টসাধ্য হবে না?
একইভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে আক্রান্ত। যেমন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় দেশীয় সুতার দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলেও ওই নির্ধারিত সীমার মধ্যেই প্রতিদিন টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে। রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর, বালু, বিটুমিন ও আলকাতরার মতো নির্মাণসামগ্রীর দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে; কর আরোপ করা হলে স্থবির বেসরকারি বিনিয়োগে বিপ্রতীপ প্রভাব পড়বে? ডলার–সংকটে মূলধন সরঞ্জাম আমদানি হ্রাসে বিনিয়োগ কমেছে। দ্রুত অগ্রগতি না হলে থমকে যাবে নতুন কর্মসংস্থান। মূল্যস্ফীতির চাপও কমবে না।
ঘরে ঘরে নগদের টান পড়েছে। বিবিএস জানিয়েছে, গত বছরের মে থেকে প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম হারে বেড়েছে। এপ্রিলে মজুরি বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৩ এবং মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ১৪৫টি স্বল্প দক্ষতার পেশা নিয়ে মজুরির হার নির্ধারিত হয়। তারা নগদ অর্থের অভাবে পর্যুদস্ত।
নিম্ন ও মধ্যমধ্যবিত্তদের কর্মসংস্থান, আয় ও সঞ্চয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নতুন দরিদ্র তৈরি হচ্ছে। দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেক বা ৯ শতাংশ তথা দেড় কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের অনুপস্থিতিতে, টিকে থাকতে, আত্মকর্মসংস্থানে বাধ্য হচ্ছে। বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে দরিদ্রদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ২০২২ সালে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে।
বিবিএস ব্যবহৃত দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন সত্ত্বেও ওই জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমেছে। গত ছয় বছরে (২০১৬-২২) দারিদ্র্য প্রতিবছর গড়ে ০.৯৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। ২০১০-১৬ সময়কালে ১.৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। সম্পদ বাড়ছে চরম হারে; অনেক কম হারে কর্মসংস্থান। পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়িয়েছে। ১২ বছর ধরে জিনি সহগ ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে ০.৪৯৯ পৌঁছেছে। ২০১৬ সালে ০.৪৮২ এবং ২০১০ সালে ০.৪৫৮ ছিল। সরকার কি খণ্ডিত, অন্তর্ভুক্তি ও বর্জনত্রুটিযুক্ত সামাজিক সুরক্ষাজাল কর্মসূচিগুলোয় কোনো পরিবর্তন আনবে? সর্বজনের কাছে নগদ সরবরাহ করতে পূর্ণ জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা কি চালু করবে?
অন্যদিকে, গণমাধ্যমে অনুমান করা হয়েছে—বাজেট কি কণ্ঠহীন, নিম্ন আয়ের লোকদের ওপর কর আরোপের সহজ পথটি বেছে নেবে এবং ধনীদের ছাড় দেবে? জন মেনার্ড কেইনস তাঁর ১৯২৩ সালের ‘আ ট্র্যাক্ট অন মনিটারি রিফর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদ সাম্প্রতিক ঘটনাবলির জন্য বিভ্রান্তিকর নির্দেশিকা। দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই মৃত।’ ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’ প্রবাদটি কি তাঁর মাথায় অনুরণন ঘটিয়েছিল!
ডলারের ঘাটতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি শিল্পের মূলধন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমিয়েছে। জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে শিল্প মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র ৫৪ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ৩০ শতাংশ কমেছে। শিল্প স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সংস্কার উদ্যোগের জন্য বাজেটের কী কী প্রস্তাব থাকবে? কীভাবে মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নগদের অভাব কমাবে?
সরকারের অর্থাভাব প্রকট। যেমন ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ৩৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ডলার–সংকটে সরকার আমদানিকারককে জ্বালানির মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। জ্বালানির মজুতও বিপজ্জনকভাবে কম। বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জসহ খরচ কমানোর জন্য চাপের মধ্যে আছে।
খেলাপি না হওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে মনোযোগ জরুরি হলেও এ আশঙ্কা অমূলক নয় যে শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ব্যাংকিং খাত শুকিয়ে যাওয়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র বাজেটের মাধ্যমে আদিম সঞ্চয়নে নিবিষ্ট হবে। এই স্বজনতোষী পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি কি কমবে?
বেশির ভাগ মানুষই আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। বেঁচে থাকার তাগিদে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করছে। তাঁদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
গত পাঁচ বছরে ঋণ গ্রহণে প্রবৃদ্ধি ৯২৭ শতাংশ। মাত্র সাড়ে সাত বছরে মোট বৈদেশিক ঋণ ১২৮ শতাংশ বেড়ে ৯৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। গত সাড়ে সাত বছরেই ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে।
সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০১৪ সালের ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ। বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যর ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতির কারণে অদূর ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন বন্ধ না–ও হতে পারে। বাজেট ঋণ-দায় কমানোর কৌশল জানাবে কি? মূল ও সুদ প্রদান বাবদ পরিচালন ব্যয় প্রায় ২০ শতাংশ—কোনো ঝাঁকুনি দিতে পারবে?
একমাত্র বিকল্প—আয়কর বৃদ্ধি, করছাড় ও জালিয়াতি কমানো। অধীর আগ্রহে জাতি কর ফাঁকি, আমদানি শুল্ক ছাড়ের স্বজনতোষী পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি এবং অর্থ পাচার বন্ধের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে অপেক্ষমাণ।
অন্যদিকে, গণমাধ্যমে অনুমান করা হয়েছে—বাজেট কি কণ্ঠহীন, নিম্ন আয়ের লোকদের ওপর কর আরোপের সহজ পথটি বেছে নেবে এবং ধনীদের ছাড় দেবে? জন মেনার্ড কেইনস তাঁর ১৯২৩ সালের ‘আ ট্র্যাক্ট অন মনিটারি রিফর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদ সাম্প্রতিক ঘটনাবলির জন্য বিভ্রান্তিকর নির্দেশিকা। দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই মৃত।’ ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’ প্রবাদটি কি তাঁর মাথায় অনুরণন ঘটিয়েছিল!
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান