এরদোয়ানের বাগদাদ সফর তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে
এরদোয়ানের বাগদাদ সফর তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে

মধ্যপ্রাচ্য মুঠোয় রাখতে ইরাকে খুঁটি গাড়ছেন এরদোয়ান

গত মাসে ইরাকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ‘ঐতিহাসিক’ সফর থেকে মনে হচ্ছে, তুরস্ক তার পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন একটি ধারণা যুক্ত করেছে। সেই ধারণা অনুযায়ী আঙ্কারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর দিকে হাঁটছে।

এই ধারণার দুটি স্তম্ভ রয়েছে। একটি হলো অর্থনীতিভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি; অন্যটি হলো আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা। আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে নানা দিক থেকে পারস্পরিক নির্ভরতা সৃষ্টি করে তুরস্ক আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে তার আঞ্চলিক নীতি পরিচালনার জন্য একটি রূপরেখা নিয়ে এগোচ্ছে। হয়তো সে কারণেই ইরাকের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানোর আগেই এরদোয়ান মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দরজায় কড়া নেড়েছেন। আসলে মধ্যপ্রাচ্য এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এবং সেখানে একটি নতুন ইতিবাচক প্রবাহের প্রয়োজন।

সিরিয়া যুদ্ধে একের পর এক মোড় পরিবর্তন, লিবিয়া ও পূর্ব ভূমধ্যসাগর এলাকায় তুরস্কের উপস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত—এর সবগুলোই তুরস্ককে তার পররাষ্ট্রনীতিতে সংকট ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য করেছে।

এই সংকটগুলোর এখনো মীমাংসা হয়নি; তবে এগুলো মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় আছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং ইরান-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিভুজ বিরোধ নিষ্পন্ন করার ক্ষেত্রে তুরস্ক তার প্রভাবকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে পেরেছে। এ ছাড়া নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাতের সময় আজারবাইজানের পক্ষ নিয়ে তুরস্ক যে সুবিধা কুড়িয়ে নিতে পেয়েছিল, সেটি আঞ্চলিক স্তরে আঙ্কারার হাতকে শক্তিশালী করেছে।

এখনো তুরস্ক ও ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত আছে এবং এই দুই শক্তির রশি–টানাটানির মূল জায়গার একটি হলো ইরাক, আরেকটি হলো সিরিয়া। এসব কারণে আঞ্চলিক ইস্যুতে আলোচনা করতে তুরস্ক অনেক আগে থেকে ইরান, সিরিয়া এবং রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে আসছে এবং এখন সে ইরাকের দিকে ঝুঁকছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্ক সেই ধরনের কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। তুরস্কের এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হতে পারে ইরাক এবং সে কারণেই তুরস্ক ইরাকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি এ লক্ষ্যে তুরস্ক ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিষয়েও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে।

ইরাকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর থেকে সেখানে ইরানি প্রভাবের প্রতি জনগণের বিতৃষ্ণার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানকার জনগণ ইরানের প্রভাবকে আর ভালোভাবে নিচ্ছে না।

২০২০ সালে বাগদাদে ইরানি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি মার্কিন হামলায় নিহত হওয়ার পর থেকে ইরাকে ইরানের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরও শুধু ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে আঙ্কারা এই অঞ্চলের ইস্যুগুলো থেকে তেহরানকে বাদ দিতে চাইছে না।

বরং তুরস্ক চায় ইরান এই অঞ্চলে তার ভূমিকা ধরে রাখুক, তবে নিয়ন্ত্রিত পরিসরে। তুরস্ক মনে করে, ইরানকে আঞ্চলিক ইস্যুগুলো থেকে যত সরিয়ে দেওয়া হবে, তেহরান তত বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। সে ধরনের পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।

ইরাকের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব একটি অর্থনৈতিক ও সেবাভিত্তিক সরকারি কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা শক্তিশালী হতে শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী সুদানি যখন তাঁর সরকারি কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তখন সেই তালিকায় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

সুদানির নেতৃত্বাধীন ইরাক এখন রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে বেশি কথা বলছে। এটিকে ইরাকি জনগণ এবং রাজনীতিবিদেরা ব্যাপকভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন। বিশেষ করে ২০২১ সালের নির্বাচনের পর থেকে প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে ইরাক সরকারের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টাকে তাঁরা ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন।

ঐতিহাসিকভাবেই ইরানের মধ্যপ্রাচ্য নীতি পরিচালনার মূল ঘাঁটি হলো ইরাক এবং তেহরান সেই ঘাঁটিকে কোনো অবস্থায় পুরোপুরি হাতছাড়া করতে চায় না। তবে সেখানে ইরানের অবস্থান এখন বেশ নড়বড়ে হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা আগে ইরাকে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডারদের যেভাবে দেখতাম, এখন সেভাবে দেখতে পাই না। উপরন্তু ইরাকি মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ইরাকের অভ্যন্তরের চেয়ে ইরাকের বাইরে বেশি তৎপরতা চালাতে পছন্দ করছে বলে মনে হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, ইরান ইরাকে তার তৎপরতা কমিয়ে দিচ্ছে।

এটি তুরস্ককে ইরাকের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে চমৎকার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ, তুরস্ক ইরাক ইস্যুতে ইরানকে সম্পূর্ণরূপে বাদ না দিয়ে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থা বজায় রেখে কাজ করতে পারছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্ক সেই ধরনের কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। তুরস্কের এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হতে পারে ইরাক এবং সে কারণেই তুরস্ক ইরাকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি এ লক্ষ্যে তুরস্ক ইরাকের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিষয়েও উদ্যোগী হয়ে উঠেছে।

● বিলগে ডুমান তুরস্কের অ্যাবান্ট ইজেট বেসাল ইউনিভার্সিটির একজন ডক্টরাল গবেষক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত