ধর্ম

লাইলাতুল কদর: হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে রাত

জীবন্ত মুজিজা মহাগ্রন্থ আল–কোরআন ২৬ রমজান দিবাগত ২৭ রমজানের রাতে প্রথম অবতীর্ণ হয়েছিল। এই রাত বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদাপূর্ণ রাত। এই রাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদর রজনী বলা হয়।

ফারসিতে বলে শবে কদর। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ কদরের রজনীতে। আপনি কি জানেন, সে মহিমাময় রাত্রি কী?

মহিমান্বিত ওই নিশি সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতারা রুহুল কুদুস হজরত জিবরাইল (আ.)–এর সঙ্গে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে ফজর পর্যন্ত।’ (সুরা-৯৭ কদর, আয়াত: ১-৫)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।

এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছ অসুস্থ, আমার কাছে চাও আমি আরোগ্য দান করব, কে আছ অভাবগ্রস্ত, আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব, কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও, আমি বিপদমুক্ত করে দেব।’ এভাবে বান্দার সব প্রয়োজনের কথা বলতে থাকেন। (মুসনাদে আহমাদ)

আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস মহান রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে চেয়ে নিতে পারেন। তিনি দিতে চান, আপনি না নিলে তিনি অসন্তুষ্ট হন। আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার প্রতি রাগান্বিত হন।’ (তিরমিজি: ৩৩৭৩)

রমজান মাস এলে রাসুল (সা.) আরও বলতেন, ‘এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে এর কল্যাণ গ্রহণ থেকে বিরত হয়, সে প্রকৃতপক্ষেই হতভাগ্য।’ (মুসনাদে আহমাদ: ৭১০৮; সুনানে নাসায়ি: ২১০৬)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো।’ (মুসলিম)

আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। মুফাসসিরিনে কিরাম বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে ৯টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিন তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে বা নয়কে তিনবার যোগ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। (তাফসিরে মাজহারি)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন; তুমি শবে কদরে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা ও সহিহাহ আলবানি)

শবে কদরে যেসব আমল করা যায়: নফল নামাজ-তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলুল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল নামাজ পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু–সিজদা দীর্ঘ করা। কোরআন তিলাওয়াত করা; নিজের জন্য, মা–বাবার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করে দোয়া করা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বনি ইসরায়েলের একজন মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি এক হাজার বছর দীর্ঘ হায়াত পেয়েছিলেন। দীর্ঘ এ আয়ুষ্কাল তিনি দিনে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে রত থাকতেন এবং রাতে ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন।’

আলী ইবনে উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাধারণ) বনি ইসরাইলের চারজন আবেদ সম্পর্কে বলছিলেন, ‘তঁারা ৮০ বছর ধরে অনবরত আল্লাহর ইবাদত করছিলেন। এর মধ্যে মুহূর্ত সময়ের জন্যও ইবাদত থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। বিখ্যাত এই চারজন আবেদ হলেন আল্লাহর নবী জাকারিয়া (আ.), আইয়ুব (আ.), হিজকিল ইবনে আজুজ (আ.) এবং ইউশা ইবনে নুহ (আ.)।’

এমনটি শুনে সাহাবিরা (রা.) রীতিমতো অবাক হলেন। এ সময় জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনার উম্মতরা এ কথা শুনে অবাক হচ্ছে? তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা এর চেয়ে উত্তম কিছু রেখেছেন।’ এরপর সুরা কদর পাঠ করা হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড: ১৮, পৃষ্ঠা: ২২৩)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    smusmangonee@gmail.com