বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় স্বপ্না নামের মেয়েটির স্বামী তাঁকে নতুন ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, দামি শাড়ি, অলংকার, গোছানো ড্রয়িংরুমসহ অনেক কিছুই কিনে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টে কিছুরই যেন অভাব নেই সংসারে। কিন্তু তাতেও স্বপ্না সেভাবে হাসিখুশি থাকতে পারছেন না। সব সময় একটা ভয়, জড়তা তাঁকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। স্বপ্নার এই ভীত চেহারা বন্ধু ও সহকর্মীদের কারও নজর এড়ায় না। সবাই দেখছে স্বপ্নার সব আছে, স্বামী সকালে গাড়িতে করে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, বিকেলে তুলে নিয়েও যান। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? স্বপ্না তো কারও কাছে কোনো অভিযোগ করছেন না।
স্বপ্না তাঁর এই দুঃখটাকে লালন করেন ভেতরে। কাউকে লজ্জায় কিছু বলেন না। খুব তুচ্ছ কারণে স্বামী যে তাঁকে সবার সামনে এবং বন্ধ দরজার ভেতরে অপমান করেন, এটা তাঁকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। স্বপ্না এটা মেনে নিতে পারছিলেন না, আবার প্রতিবাদও করতে পারছিলেন না। এই জাঁতাকলে পড়ে মেয়েটির নিজের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল, অন্যমনস্কতা বাড়ছিল, সন্তান তাঁর ব্যবহারের প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছিল এবং পরিবারের অন্যরা এই দুঃখবোধকে ঢং বলে মনে করতে শুরু করেছিল। স্বপ্না একটি উদাহরণমাত্র, তাঁর মতো আরও অসংখ্য চরিত্র আছে এই সমাজে, যাঁরা গ্যাসলাইটিং অর্থাৎ জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণের শিকার।
সঙ্গীকে সবার সামনে ছোট করা, অবিশ্বাস ও অসম্মান করাটা যে একধরনের অত্যাচার, তা সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন না। সবাই তা অনুভবও করতে পারেন না। নির্যাতন সব সময় শারীরিক না-ও হতে পারে। মানসিকভাবে হেনস্তা করা ও লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমেও মানুষকে নিপীড়ন করা যায়। সেদিন ওয়েব সিরিজ লজ্জা দেখে মনে হলো আমি অথবা আমার চারপাশে অনেকেই এ রকম নির্লজ্জ আচরণের শিকার।
সিরিজটিতে খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্যাসলাইটিংয়ের মতো বিষয়টিকে। এখানে যে মূল নারী চরিত্র, তার জীবনের গল্পের সঙ্গে এ দেশের অনেক নারীর জীবনের মিল আছে। অবশ্য শুধু গালিগালাজ করা বা অশ্রাব্য কথা বলাই মৌখিক নিগ্রহ নয়। ‘তোর বা তোমার দ্বারা কিছু হবে না’—আপাতদৃষ্টে সামান্য এই কথাটা দিনের পর দিন কাউকে বলে যাওয়ার মাধ্যমেও ভেঙে দেওয়া যায় মানুষের মনের জোর। সামাজিক পরিসরে, গৃহ অভ্যন্তরে বা বেডরুমের ভেতরে এমনভাবে সঙ্গীকে লজ্জা দেওয়া যায়, যাতে সঙ্গীর মনোবল একেবারে তছনছ হয়ে যায়। কারও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করা বা কাউকে হেয় করার মাধ্যমে তাঁকে অসহায় ও দুর্বল করে ফেলার একটা ভালো অস্ত্র হচ্ছে তাঁকে ক্রমাগত লজ্জা দেওয়া। লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমে অন্যকে হেয়, সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণ করার এই অসুখের একটি নাম আছে। এর নাম ‘গ্যাসলাইটিং’। শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, আমাদের চারপাশে ঠিক এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।
সাধারণত পারিবারিক পরিসরে এসব ঘটনা ঘটে। কোনো স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান বা কোনো প্রেমিক যখন তার প্রেমিকার ওপর দখলদারি কায়েম করতে চান বা কোনো স্ত্রী যদি স্বামীকে অবিশ্বাস করেন বা সব সময় চোখে চোখে রাখতে চান, তখনই বুঝতে হবে এটি একটি অস্বাস্থ্যকর ও অসুন্দর দাম্পত্য সম্পর্ক বা জুটি। এই সম্পর্ককেই মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘গ্যাসলাইট আচরণ’। পারিবারিক সহিংসতার একটি বড় অস্ত্র এই গ্যাসলাইটিং।
কীভাবে কেউ গ্যাসলাইিটংয়ের শিকার হচ্ছেন, তা বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের উপায় বাতলে দিয়েছেন। কারণ, এই অত্যাচার মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে দেয়, মানসিক ট্রমা বাড়িয়ে তোলে এবং মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। মনোবিদেরা বলেন, গ্যাসলাইটের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রমাণ জোগাড় করতে হবে নিজের তথ্যের পক্ষে, যেন কেউ বলতে না পারেন যে আপনি ভুল বলছেন বা কথা ভুলে যাচ্ছেন।
গ্যাসলাইটিং হচ্ছে একধরনের মানসিক নির্যাতন। একজন ব্যক্তি যখন অন্য একজন ব্যক্তিকে তার বিবেচনাবোধ, স্মরণশক্তি অথবা দুর্বল বাস্তবতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বা খোঁটা দেন, তখন তা এই গ্যাসলাইটিংয়ের মধ্যে পড়ে। যে ব্যক্তি এ ধরনের ব্যবহারের শিকার হন, তারা দ্বিধান্বিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ক্রমে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তখনই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তির পক্ষে।
এই গ্যাসলাইট শব্দটি কেন মানসিক নির্যাতনের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হলো, এটা বুঝতে হলে ১৯৪৪ সালের একটি সিনেমা ও ১৯৩৮ সালে প্রদর্শিত একটি নাটক সম্পর্কে জানতে হবে। সেখান থেকেই এই গ্যাসলাইট শব্দটি নেওয়া হয়েছে। সেই কাহিনিতে একজন নির্যাতনকারী স্বামী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে তার স্ত্রী হেলুসিনেট করছে। এ জন্য স্বামী তাদের গ্যাস পাওয়ারের লাইটকে একবার উজ্জ্বল করেন এবং আরেকবার আলো কমিয়ে দেখাতে থাকেন। এই কাজ ক্রমাগত করার মাধ্যম সে স্ত্রীকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলে প্রতিষ্ঠিত করার ও কোণঠাসা করার চেষ্টা করেন। একসময় স্ত্রী নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তিনি আসলেই মানসিকভাবে অসুস্থ। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। বহু বছর ধরে মানসিক নির্যাতনের জন্য এই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে গ্যাসলাইটিং টার্মটা নতুন অনেকের কাছে।
গ্যাসলাইটিং কীভাবে মানুষের ওপর কাজ করে? মানুষের নিজের ওপর বিশ্বাস নষ্ট করে দেওয়ার মাধ্যমেই এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। একবার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দিতে পারলে কারও ওপর নিয়ন্ত্রণ করাটা সহজ হয়। এই লজ্জা ওয়েব সিরিজটির মতোই আমাদের চারপাশে লক্ষ করলে দেখা যাবে অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীকে সবার সামনে ‘ফাজলামি করার ভঙ্গি’তে হেয় করছেন, সেটা কখনো বন্ধুদের আড্ডায়, কখনোবা আত্মীয়-পরিজনের সামনে। এই ব্যক্তি কখনো স্ত্রীর দুর্বল স্মরণশক্তি নিয়ে হাসাহাসি করেন, স্ত্রীর বক্তব্য ঠিকমতো বুঝতে না পারার মতো ভান করেন। এ ক্ষেত্রে অনায়াসে বলে ফেলেন যে তুমি গুছিয়ে কথা বলতে ও কাজ করতে পারো না। নিগ্রহকারী ব্যক্তি ঘরে আর বাইরে দুটি আলাদা রূপ ধারণ করেন। বাইরের মানুষের সামনে সে এতটাই ভালো থাকার চেষ্টা করেন, যেন স্ত্রী কারও কাছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করলেও কেউ তা বিশ্বাস করবে না।
এ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্ত্রীকে মুখের ওপর বলে ফেলা যে ‘আরে তুমি কী বোঝো? চুপ করো’, ‘মেয়ে মানুষ, মেয়ে মানুষের মতো থাকো’ অথবা বলে যে ‘মেয়ে মানুষের আবার বুদ্ধি, সে তো মুরগির চেয়েও কম’ ইত্যাদি। এ ধরনের অসম্মানজনক কথা বাঙালি সমাজে খুব চর্চিত। নারীকে অসম্মান করার জন্য ও দুর্বল করে রাখার জন্য এ যেন চলমান প্রক্রিয়া। গ্রামগঞ্জে, নগরজীবনে, শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তের সংসারে এ যেন পরিচিত দৃশ্য।
গ্যাসলাইটিং ইস্যুটা ইদানীং সিনেমাসহ সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ফোরামে আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে অনেকেই প্রকাশ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন এবং গ্যাসলাইটিংকে ইমোশনাল অ্যাবিউজ করার অস্ত্র হিসেবে মনে করছেন। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে সেমিনারে আলোচনা করা হলেও মানুষের কাছে তা সব সময় বোধগম্য হয় না এবং সবার কাছে তা পৌঁছায়ও না। তাই যদি লজ্জার মতো সিনেমা, নাটক ও ওয়েব সিরিজ দিয়ে মূল স্রোতের গল্প হিসেবে এই আচরণকে সবার কাছে তুলে ধরা যায়, তাহলে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটা সহজে হবে।
নেটফ্লিক্সে মেইড নামে একটি সিরিজে ঘুরেফিরে এই গ্যাসলাইটিং আচরণের কথা এসেছে। খুব বেদনাদায়ক এই ছবিটি একটি সত্যি কাহিনির ওপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছে। একজন সিঙ্গেল মায়ের জীবনের কষ্ট দেখানো হয়েছে, যে মা তার সঙ্গীর কাছে মানসিকভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন এবং একসময় তা শারীরিক নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল। এই ভয়ংকর ও অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে কীভাবে মানুষ মুক্ত হতে পারে, সে কথাই উঠে এসেছে।
দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় এই গ্যাসলাইটং প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে শুরু হয়। স্বামী যখন স্ত্রীর ওপর নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার জন্য অভিযোগ করতে শুরু করেন, যেমন তুমি প্রায়ই ভুলে যাও, তুমি অমনোযোগী, তুমি দায়িত্বপরায়ণ নও ইত্যাদি, তখন ক্রমশ স্ত্রীও মনে করতে শুরু করেন যে তার পার্টনারই ঠিক। স্ত্রীর মধ্যে এই ধারণা যত বাড়তে থাকবে, ততই বুঝতে হবে নির্যাতনকারী ব্যক্তির ক্ষমতা বাড়ছে। একসময় নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে নির্যাতিত ব্যক্তি কোনো কিছু স্মরণ করার জন্য বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সঙ্গীর মতামতের ওপর বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। সাধারণত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই আচরণ বেশি ঘটে।
এ ছাড়া আরও আছে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে বাধ্য করা, একবার না পেলে বারবার ফোন করা, অর্জিত অর্থের ওপর হাত দেওয়া, ফোন অর্থাৎ কল লিস্ট চেক করা, ইন্টারনেট হিস্টরি চেক করা, জোর করে ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানতে চাওয়া। প্রতিপক্ষ আপসেট না হওয়া পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করতেই থাকা। স্ত্রীকে বা বন্ধুকে আজেবাজে নামে ডাকা যেমন ইডিয়ট, বোকা, গাধা ইত্যাদি।
গ্যাসলাইট শুধু দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ঘটে, তা নয়। অনেক সময় মা-বাবাও সন্তানকে অন্যের সামনে দুর্বল, বোকা, লেখাপড়ায় খারাপ, কিছু পারে না—এ ধরনের কথা বলে শাস্তি দিতে চান। এভাবেই তাঁরা সন্তানকে অসহায় করেন বা ছোট করেন। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস ও কর্মোদ্দীপনা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই আছেন যারা ইচ্ছা করে অন্য মানুষের বয়স, চেহারা, পোশাক, লিঙ্গ, জেন্ডার ধারণা, জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাস নিয়ে বাজে মন্তব্য করে বা ছোট করে, এটাকে জাতিগত গ্যাসলাইটিং বলে।
রাজনৈতিক গ্যাসলাইটিং হচ্ছে যখন একটি রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে হেয় করার জন্য জনগণের কাছে মিথ্যা বলে। অনেক সময় নিজেদের ভুল চাপা দেওয়ার জন্য এমন বিতর্কের জন্ম দেয় যেন জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে যায়।
চাকরিক্ষেত্রেও মানুষকে নানাভাবে হেয় করা হয়। একজন দক্ষ কর্মীকেও তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার মাধ্যমে পেশাগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও গ্যাসলাইটিং হয়। প্রতিষ্ঠানের ভুলত্রুটি নিয়ে যারা কথা বলেন বা যে হুইসেলব্লোয়ার হন, তাদেরকে এই গ্যাসলাইট করার মাধ্যম অকার্যকর করা হয়।
এই নিপীড়নের আরও অনেক চেহারা আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাটাও একধরনের নিগ্রহ। একজন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কোথায় যাবেন? কী করবেন? এই বিষয়গুলো নিয়েও যখন কেউ মন্তব্য করেন বা চাপাচাপি করেন সেটাও নিপীড়ন। ‘এটা কোরো না’, ‘এখানে যেয়ো না’, ‘অমুকের সঙ্গে মিশবে না’, ‘এ ধরনের পোশাক পরবে না’ ইত্যাদি কথা প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকা মানুষটিও ভুলে যায় নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া না-চাওয়ার কথা। আমরা কেউই মৌখিক নিগ্রহের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই না বা কথা বলি না, এমনকি ভিকটিম এবং তার পরিবার-পরিজনও এই অপমানকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। এটা যে আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটাও বহু মানুষের কাছে অজানা।
অনেকে ভাবতে পারেন, শুধু নারীই হয়তো গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন। ছেলেদেরও এর সম্মুখীন হতে হয়, তবে তুলনায় অনেক কম। আমাদের চারপাশটা দেখলেই বোঝা যায়, যতটা সহজে একটি মেয়েকে মৌখিক নিগ্রহ করা সম্ভব, একটি ছেলেকে অতটা সহজে করা যায় না। নিগ্রহ করার ব্যাপারটা মূলত নির্ভর করে ক্ষমতার ওপর। যার ক্ষমতা যত বেশি, সেই তত শক্তি প্রদর্শন করে। ছেলেদেরও অফিসে, বাড়িতে, পাড়ায় নানা ধরনের মৌখিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়। এমনকি সংসারের নারী সদস্যদের দ্বারাও ছেলেরা কটূক্তির শিকার হয়।
স্ত্রী ও স্বামী দুজনই গ্যাসলাইটিং করতে গিয়ে পরস্পরের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন, বারবার ফোন করেন, ছবি বা টেক্সট পাঠানোর জন্য জোর করেন। দুজনই এর মাধ্যমে নিশ্চিত হতে চান যে সঙ্গী তার অবস্থান সম্পর্কে মিথ্যা বলছে কি না। এ ছাড়া আরও আছে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে বাধ্য করা, একবার না পেলে বারবার ফোন করা, অর্জিত অর্থের ওপর হাত দেওয়া, ফোন অর্থাৎ কল লিস্ট চেক করা, ইন্টারনেট হিস্টরি চেক করা, জোর করে ফেসবুক পাসওয়ার্ড জানতে চাওয়া। প্রতিপক্ষ আপসেট না হওয়া পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করতেই থাকা। স্ত্রীকে বা বন্ধুকে আজেবাজে নামে ডাকা যেমন ইডিয়ট, বোকা, গাধা ইত্যাদি।
যারা দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই আচরণ করেন, তারা একবার খুব ভালো ব্যবহার করেন, কিছুক্ষণ পর রাগারাগি করে চরম অভদ্র আচরণ করতে পারেন। যারা গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন, তারা চট করে বুঝতেই পারেন না যে তারা গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন। তাদের আত্মবিশ্বাস এতটাই কমে যায় যে নিজের স্মরণশক্তির ওপরও আস্থা কমে যায়।
এই গ্যাসলাইটিংয়ের কারণে একজন ব্যক্তি নিজে অনিশ্চিতবোধ করেন, নিজেকে ফালতু বলে মনে করেন অথবা নিজের স্মৃতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন। একপর্যায়ে নিজের অনুধাবনশক্তির ওপরও বিশ্বাস কমে যায়। তখন তিনি ভুল হয়েছে ভেবে নির্যাতনকারী ব্যক্তির কাছে ক্রমাগত ক্ষমা চান। নিজেকে দুর্বল, এমনকি পাগলও মনে করেন। অনেক সময় নির্যাতনকারীর ব্যবহার অন্যদের কাছে গোপন করেন এবং মাঝেমধ্যে সমর্থনও করেন। এভাবে নির্যাতিত মানুষ নিজেকে একা করে ফেলেন।
অনেকের সঙ্গে এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেছে, অনেকের পরিবারে এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কোথাও গিয়ে এটা প্রকাশ করতে পারেন না। কীভাবে এর হাত থেকে মুক্তি পাবেন, তা-ও বুঝতে পারেন না। পরিবারের নারী সদস্যরাও অনেক সময় নিজের অজান্তে এই নিগ্রহের অংশ হয়ে ওঠেন। ছোট থেকে মেয়েদের ‘মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়া’ শেখানো হয় বলেই লজ্জা গল্পে মা তাঁর মেয়েকে বারবার মেয়ের ওপরে হওয়া অসম্মানকে মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সচরাচর আমাদের সমাজে এটাই হয়।
আবার সংসারে অনেক কিছু পাওয়ার পরেও কেন বউমা স্বামীর বকাবকি ও শ্বশুরবাড়ির মানুষদের দুকথা সহ্য করতে পারে না, এটা শাশুড়ি মেনে নিতে পারেন না। পরিবারে মা বা বাবা যদি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন, সেটা শিশুর ওপর খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পরিবারে বাচ্চারা যদি গ্যাসলাইটিং আচরণ দেখে, সেটা হবে খুব ক্ষতিকর। তাই পরিবার থেকেই সবাইকে সংযত হতে হবে।
কীভাবে কেউ গ্যাসলাইিটংয়ের শিকার হচ্ছেন, তা বোঝার জন্য মনোবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের উপায় বাতলে দিয়েছেন। কারণ, এই অত্যাচার মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে দেয়, মানসিক ট্রমা বাড়িয়ে তোলে এবং মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। মনোবিদেরা বলেন, গ্যাসলাইটের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রমাণ জোগাড় করতে হবে নিজের তথ্যের পক্ষে, যেন কেউ বলতে না পারেন যে আপনি ভুল বলছেন বা কথা ভুলে যাচ্ছেন।
ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারেন। ভালো বন্ধু বা কাছের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, বুদ্ধি নিতে পারেন। কারণ, দিনের শেষে সে আপনার সাক্ষী হিসেবে থাকবে। ছবি রাখতে পারেন, ভয়েস রেকর্ড করে রাখতে পারেন। এগুলো আইনি লড়াইয়ে কাজে লাগবে। এ ছাড়া আরও উপায় হচ্ছে নারী বা অন্য সহায়তাকেন্দ্রের সাপোর্ট নেওয়া, থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া।
তবে গ্যাসলাইটিংয়ের এই আচরণবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে। কারণ, প্রথমে ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে বিশ্বাস করতে হবে যে তার প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে, তার জন্য সে দায়ী নয়, এই মনে করাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়।
শাহানা হুদা যোগাযোগবিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক