দেশে ধনী হওয়া এত সহজ হলো কেন

কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম এখন দুবাই ও লন্ডন পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে, ডলার-সংকটে জাহাজ থেকে মাল খালাস করা যাচ্ছে না। কেন? সম্ভবত, সবচেয়ে নরম উত্তর আছে নিচের উদাহরণ কয়টিতে।

বিল গেটস ও কার্লোস স্লিম। একজন মার্কিন, একজন ম্যাক্সিকান। দুজনেই বিশ্বসেরা ধনী। তাঁদের ধনী হওয়ার প্রক্রিয়াটা দুই রকম।

বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তির মর্যাদা এবং বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি উদ্ভাবক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিল গেটসের অবস্থান মার্কিন বিচার বিভাগকে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রাখেনি। ১৯৯৮ সালের ৮ মে দাবি তোলা হয়, মাইক্রোসফট তার একচেটিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। সরকার তাকে বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখে। ২০০১ সালের নভেম্বরের দিকে মাইক্রোসফট বিচার বিভাগের সঙ্গে সমঝোতায় আসে। মাইক্রোসফটের জরিমানা করা হয় ও তার শাখা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কার্লোস নিজস্ব উদ্ভাবনের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করেননি। প্রথম দিকে স্টক মার্কেট থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। তাঁর বড় উত্থানটি ঘটে ট্যালিম্যাক্স মানে মেক্সিক্যান টেলিকমিউনিকেশনের একচেটিয়া কারবারটি অধিগ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানটিকে ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট কার্লোস সালিনাস বেসরকারি খাতে ৫১ শতাংশ ছেড়ে দেয়। কার্লোস সর্বোচ্চ দর না রেখেও নিলাম জেতেন। যথাসময়ে শেয়ারগুলোর মূল্য পরিশোধও করতে হয় না। তারপর টেলিম্যাক্সের লাভ দিয়েই স্টকগুলোর মূল্য পরিশোধ করেন। জনগণের একচেটিয়া লাভজনক কারবারের স্বত্ব কার্লোস স্লিমের মালিকানায় চলে গেল।

আপনি যদি মেক্সিক্যান উদ্যোক্তা হন, তবে ক্যারিয়ারের পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবেন। বাধাগুলোর মধ্যে উচ্চমূল্যের লাইসেন্সও আপনাকে অর্জন করতে হবে, লাল ফিতার বাধা পেরিয়ে যেতে হবে। রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাসীনেরা আপনার পথ রোধ করে দাঁড়াবে। যে ক্ষমতাসীনেরা আপনার প্রতিযোগী, তারা পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহে বাধা দেবে। হয় আপনাকে এসব বাধা অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না, অথবা আপনাকে লাভজনক খাতগুলো থেকে দূরে রাখা হবে, নয়তো আপনাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হবে। অতএব আপনি চেনাজানাদের মাধ্যমে ঘুষ দেবেন। এই যে কার্লোস স্লিম যখন দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য করতে গেলেন, সেখানে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিলেন।

এই যে আমেরিকা ও মেক্সিকো সীমান্তের নোগোলোস সিটির দুই অংশের মধ্যে যেমন ভেদ, একই পরিস্থিতি আমেরিকা মহাদেশের উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে। কিসের জোরে প্রাকৃতিকভাবে কম সম্পদের অধিকারী হয়েও উত্তর গোলার্ধ দক্ষিণের চেয়ে ধনী হয়ে উঠল? এক শব্দবন্ধে যদি উত্তর দিতে হয়, তাহলে তা হবে ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান’।

২.

ভারতের মানিলাইফ ডট ইন দীর্ঘদিন ধরে এই ঋণখেলাপিদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করছে। গত আগস্ট মাসে তাদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হচ্ছে, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা ২ হাজার ২৩৭। মোট ঋণখেলাপের পরিমাণ ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা৷

এই মোট ঋণখেলাপের অঙ্কের ৭৬ শতাংশ রয়েছে মাত্র ৩১২ জন বিগ শট শিল্পপতির হাতে। তাঁদের মোট ঋণখেলাপের পরিমাণ ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। নিন্দুকেরা বলেন, আসলে কোনো সরকারই এই তালিকা প্রকাশ করতে চায় না। প্রকাশ করলে কান টানতে মাথা চলে আসবে।

নাম প্রকাশ করা যাবে না—এই শর্তে ভারতীয় এক প্রবীণ সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তখন কংগ্রেস আমল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর অফিসে তিনি বসে আছেন, এমন সময় এক বিখ্যাত উদ্যোগপতির ফোন আসে তাঁর কাছে। খানিকক্ষণ কথা বলার পর সাংবাদিকের সামনে বসেই অর্থমন্ত্রীর অফিস থেকে ফোন যায় একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে। নির্দেশ যায়, ওই উদ্যোক্তাকে যেন ঋণ দেওয়া হয়। স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশ পাওয়ার পর কোনো ব্যাংকের মুরদ নেই ঋণ দিতে অস্বীকার করার। বর্তমান খেলাপিদের তালিকায় এখন ওই উদ্যোক্তার নামও আছে এবং বিজেপি আমলেও বহাল তবিয়তে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কেন ভারত-বাংলাদেশে একই ফল?

প্রায় সময় আদালত দুদকের উদ্দেশে মন্তব্য করে থাকেন। সংবিধানের ভেতরে থেকেই তা করতে হয়, তাও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ করতে হলে সরকার চালানোর আইনকানুন যে বদলাতে হয়, সেটি তো আর করা হয় না।আদালতেরও সেটি করার সুযোগ নেই।

৩.

বিখ্যাত জার্মান গবেষক ও লাতিন-বিষয়ক ভূগোলবিদ আলেক্সান্ডার ভন হাম্বোল্টের ভাষায়, মেক্সিকো একটি অসাম্য ও প্রভেদের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে ব্যাংকগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল, মেক্সিকোতে তা ছিল না। প্রতিযোগিতাহীনতার মানে হলো ব্যাংকগুলো চড়া সুদে ঋণ দিত এবং তা অল্প কিছু এলিটের মধ্যে। মেক্সিকোতে বারবার সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা রয়ে গেছে। যেভাবে মিসর অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ফরাসি হয়ে ব্রিটিশ কলোনির অধীন, তারপর মিসরীয় অভিজাতরা। কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়ে যায়, মৌলিক কাঠামোর কোনো বদল হয় না। মিসর দরিদ্রই থেকে গেল। তাহরির স্কয়ারেও এই মৌলিক রূপান্তরের কথা ছিল না।
কথা উঠতে পারে, তাহলে পুতিনের রাশিয়া কিংবা সি চিন পিংয়ের চীন কেমনে উন্নতি করল? তা-ও ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় হয়নি। রাশিয়ায় ১৯২১ সালের নয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও চীনে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ভূমির জাতীয়করণের ফলে ঘটেছে। রাশিয়া ভেঙে পড়েছে আর চীন নিজেকে যুগের সঙ্গে পাল্টে নিচ্ছে। এটাই কারণ।

৪.

প্রায় সময় আদালত দুদকের উদ্দেশে মন্তব্য করে থাকেন। সংবিধানের ভেতরে থেকেই তা করতে হয়, তাও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ করতে হলে সরকার চালানোর আইনকানুন যে বদলাতে হয়, সেটি তো আর করা হয় না।আদালতেরও সেটি করার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদে কে আছেন, তা জানতে গুগল করতে হয়। কেন তিনি নিধিরাম সরদার? কারণ, তিনি একটি পদের ইচ্ছাধীন। আগে ছিলেন বড়লাটের, পরে গভর্নর জেনারেলের, এখন প্রধানমন্ত্রীর। মানে প্রধানমন্ত্রী জবাবদিহির মধ্যে থাকলে তাঁর জবাবদিহিও নিশ্চিত হবে।

ঔপনিবেশিকেরা এসে যে লুটপাটের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, চলে যাওয়ার পর নতুন ক্ষমতাসীনেরা চর দখলের মতো সেগুলোর সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর নাগরিকেরা অভিজাতদের ছুড়ে ফেলে এমন ব্যবস্থা নির্মাণ করেছিল, যেখানে জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তার মূলে ছিল ১৬৬৮ সালে অর্জিত রাজনৈতিক অধিকার, ১৭৭৬ সালে আমেরিকার সংবিধান ও ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব, যাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বদলে স্থানীয় সরকারের হাতে সব কর্তৃত্ব চলে আসে। মানে রাজনৈতিক ক্ষমতা কীভাবে সমাজে বিতরণ করা হয়েছে তার ওপর। মানে রাষ্ট্র সংস্কার লাগবে।

রাষ্ট্রের সংস্কার হয়নি বলে আমাদের ধনীরা আলাদিনের চেরাগ পায়। যাদের জুতা কেনার পয়সা ছিল না, তারাও লন্ডনে-আমেরিকায় বাড়ি কেনে। সিঙ্গাপুরের সেরা ধনীদের তালিকায় নাম ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের পরেও এটা হলো না। কেন?

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1@gmail.com