হেঁটে হেঁটে, ঘুরে ঘুরে এই রাজধানী শহর, এর নানা মানুষ, বৃক্ষরাজি দেখা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। মাসে এক দিন, দুই দিন এই অভ্যাসের অনুশীলন করি। যতই এই শহরকে দেখি, যতই এর মানুষকে দেখি, ততই বিষণ্ন হয়ে ওঠে মন। কেন আশাবাদী হতে পারছি না, নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি। উত্তর পাই না।
রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে থাকি অনেক বছর। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর এখানকার মানুষেরা দ্রুত গুলিস্তান, ঢাকা মেডিকেল, শাহবাগ পৌঁছাতে পারছে, এটা আংশিক সত্য। কারণ, ছুটির দিন কিংবা কর্মদিবস—সব দিনেই এই ফ্লাইওভারে এত যানজট থাকে, অনেকেই ওপরে উঠতে আগ্রহী হন না। কারণ, পয়সা খরচ করে টোল দিয়ে জ্যাম ‘উপভোগ’ করার কোনো মানেই হয় না।
এই ফ্লাইওভারে ভরদুপুরে এত যানজটের কী কারণ থাকতে পারে, বুঝি না। কখনো কখনো গাড়ি ফেঁসে যায়, এতে আচমকা জ্যামের সৃষ্টি হয়। তখন গাড়িটি দ্রুত সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ কাজ যত দেরি হয়, তত মুসিবত বাড়তে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ফ্লাইওভারের ওপরে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নেই। সাধারণ বিচারে এখানে ট্রাফিক লাগার কথা নয়, কিন্তু মাঝেমধ্যে পরিস্থিতি এতই এলোমেলো হয়ে যায়, তখন মনে হয় এটার দরকার আছে। তা ছাড়া পেশাদার মোটরসাইকেলচালকেরা এতটাই বেপরোয়া থাকেন, সেখানে কোনো স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
যখন গুলিস্তান পৌঁছাই, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অগ্রহায়ণ মাস। সন্ধ্যা নেমেছে আরও অন্তত ঘণ্টাদুয়েক আগে। একদা রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বলা হতো এই গুলিস্তানকে। ফারসি এই শব্দের অর্থ ফুলের বাগান। এই ফুলের বাগানে সাপ ঢুকেছে বহু আগে। হরেক রকমের প্রতারণা এখানে হতো। অনেক ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি।
রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে অধিক জনবসতি, সরু রাস্তা, ভিড়ভাট্টা, রান্নার গ্যাসের তীব্র সংকটের দীর্ঘ বয়ান এখানে উল্লেখ না করে আমরা বরং আজ শহরটা ঘুরে আসি। এর আগে বলতে হবে পুরান ঢাকার নিকটবর্তী জনপদ যাত্রাবাড়ী, দোলাইরপাড়, পোস্তগোলা, জুরাইন এলাকায় কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
দোলাইরপাড় থেকে শুরু হয়েছে নান্দনিক বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, যা পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা গিয়ে শেষ হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গগামী বড় বড় পরিবহনের কাউন্টার এখন এদিকে চলে এসেছে। এখানকার মানুষের আর বাসে খুলনা-বরিশাল যাওয়ার জন্য সায়েদাবাদ বা গুলিস্তানের কাউন্টারে যাওয়া লাগছে না। পাশাপাশি সড়কের পাশে রেস্তোরাঁসহ নতুন নতুন দোকানপাট তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে।
পদ্মা সেতু চালুর পর রাস্তায় মোটরসাইকেলের প্রচুর ভিড় হচ্ছে, বিশেষ করে রাতে। শত শত তরুণ (তরুণীরাও আছেন) এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাওয়া যাচ্ছেন অ্যাডভেঞ্চার করতে। মাওয়া ঘাট যেন এখন ঢাকার পূর্বাঞ্চলের রাজধানী। রাতে ইলিশভাজা খেতে, ঘুরতে-বেড়াতে অসংখ্য মানুষ সেখানে যাচ্ছেন। শৃঙ্খলার অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার উদ্যাপন হয় লাগামছাড়া। রাতে এই সড়কেও তা–ই হচ্ছে। এ কারণে অবধারিতভাবে কখনো কখনো দুর্ঘটনার খবরও আসছে।
আমাদের ভ্রমণ শুরু হোক। দোলাইরপাড় থেকে যে সড়ক দয়াগঞ্জের দিকে গেছে, একসময় এখানে খাল ছিল। সেই খাল ও পানিপ্রবাহ বন্ধ করে এখানে সড়ক নির্মাণ করা হয়। যেভাবেই হোক, সড়কটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা হয়ে যাঁরা ঢাকা আসেন, তাঁরা সড়কটি ব্যবহার করেই গুলিস্তানসহ অন্যান্য অঞ্চলে যান। কিন্তু মঙ্গলবার বিকেলে এই সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে, দুই পাশ দেখতে দেখতে খুবই বিপন্ন বোধ করলাম। পুরো সড়কটির শরীর ক্ষতবিক্ষত। সড়কটিকে যদি একজন মানুষের সঙ্গে তুলনা করি, তবে সেই মানুষের শরীরের জায়গায় জায়গায় মাংস নেই, ভেতরের হাড্ডি-কলকবজা বেরিয়ে এসেছে, এমনই দৃশ্য তৈরি হবে।
দুই পাশে কাঁচা তরকারি, সবজির দোকান। অথচ পাশেই কাঁচাবাজার। সেই হিসেবে কোনোভাবেই সড়কে দোকান বসতে পারে না। এসব যাঁর দেখার দায়িত্ব, সেই জনপ্রতিনিধিরা কোথায়, আল্লাহ মালুম। অবশ্য তাঁরা যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখনো এসব দেখতেন না। কারণ, এসব দোকান থেকে চাঁদার টাকা ভালোই ওঠে। চাঁদার টাকা এখনো উঠছে। ভাগ–বাঁটোয়ারাও হচ্ছে। অথচ দেশে সংস্কারের মৌসুম চলছে।
সড়কটির সড়কদ্বীপে বেশ গাছ লাগানো হয়েছিল। গাছগুলোও বড় হচ্ছে। গাছগুলো বড় হলে এই এলাকার চেহারা অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু যত্নের অভাবে অনেক গাছ মরে গেছে। যত্নটা করবে কে? দুই পাশের যাঁরা দোকানদার-ব্যবসায়ী, এটা তাঁদের কাজ ছিল। ব্যক্তি উদ্যোগের দরকার ছিল। কিন্তু এমন কিছু দেখা যায়নি।
আপনি যদি এলাকাটি দিয়ে হেঁটে যান, দেখবেন দোকানের মালামাল রাস্তার ওপর রেখে কর্মচারীরা কাজ করছেন। গ্রিল ঝালাই থেকে শুরু করে স্টিলের শিট কাটা—হেন কোনো কাজ নেই, যা রাস্তার ওপর চলে না। আজকাল কেউ কাউকে কিছু বলে না। কারণ, বললে আবার কী বিপদ হাজির হয়!
দয়াগঞ্জ মোড় এ অঞ্চলের একটি ব্যস্ত এলাকা। এখানে দুটি বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সারা দিন মানুষ লেগেই থাকে, সন্ধ্যার পর আরও বেশি। সেই দয়াগঞ্জ মোড়ে রাস্তাঘাট এতটা শোচনীয় ছিল, বৃষ্টি হলে মনে হতো ছোট ছোট পুকুর। সম্প্রতি তা কোনোরকম মেরামত করা হয়েছে। আর এখন এই শুকনা মৌসুমে ধুলার কথা কী বলব। অনেকটা ‘ধুলার রাজ্যে দয়াগঞ্জ গদ্যময়’ অবস্থা।
দয়াগঞ্জ মোড় থেকে চারটি রাস্তা চারদিকে চলে গেছে। বাঁ দিকেই বিখ্যাত গেন্ডারিয়া। শোনা যায়, একসময় এখানে প্রচুর গেন্ডারি (আখ) চাষ হতো। সেখান থেকে নাম হয়েছে গেন্ডারিয়া। আরেকটি মত হলো, এক ইংরেজ ভদ্রলোক ঘোড়ায় চড়ে এখানে আসেন। তখন এলাকাটি বেশ ফাঁকা। বসতি তেমন তৈরি হয়নি। চারদিকটা এত খোলামেলা দেখে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, ‘হোয়াট এ গ্র্যান্ড এরিয়া।’ এ থেকে নাম হয় গেন্ডারিয়া।
তা যেভাবেই হোক, গেন্ডারিয়া আমার প্রিয় একটি এলাকা। এখানে কিছুটা হলেও বাসিন্দাদের মধ্যে একধরনের আনন্দের বসবাস লক্ষ করা যায়। গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি, সীমান্ত গ্রন্থাগার, কামাল স্মৃতি পাঠাগার, ধূপখোলা মাঠকে ঘিরে এখানকার বাসিন্দারা নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকেন। তবে পুরোনো অনেক সংগঠক ইহলোক ত্যাগ করেছেন, অনেকেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আবার তরুণেরা সে জায়গা নিয়েছেন, এটাও সত্য।
দয়াগঞ্জ মোড় থেকে রাজধানী মার্কেটে যাওয়ার রাস্তাটা এখন একটু পাতে তোলার মতো হয়েছে। রাস্তার পাশে আছে পুরোনো মন্দির। সারা বছরই ধর্মীয় কাজ চলে। বেশ কিছু খাবার ও পোশাকের দোকান হয়েছে। এখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আলাদা ভবন হয়েছে, তারপরও পুরোনো ভবনে বসবাস থেমে নেই।
বাঁ পাশে ওয়ারী। ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা। বছরখানেক আগে একদিন সন্ধ্যায় টিপু সুলতান রোড দিয়ে যাওয়ার সময় চারপাশের নির্জীব অবস্থা দেখে মনটা দমে গিয়েছিল। চার শ বছরের শহরের একসময়ের জমজমাট টিপু সুলতান রোডের সেই কলরব কোথায়? ভাঙা রাস্তাঘাট, স্বল্প আলোর গুটিকয় রেস্তোরাঁ, তাতে খরিদ্দারদের কম উপস্থিতি। মনে হয়েছিল, সন্ধ্যাবেলায় বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ঢাকা শহর!
রাজধানী মার্কেট থেকে আবারও হাঁটতে থাকি গুলিস্তানের দিকে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক কলেজের ফটক পার হয়ে বঙ্গভবনের পেছনের সড়কে এলেই আমি চমকে উঠি। ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি এখানেই ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিলাম।
‘স্যার স্লামালিকুম। কেমন আছেন? অনেক দিন আপনার সঙ্গে দেখা হয় না। আমার বড় ভাই প্রায়ই আপনার কথা বলেন।’ রিকশা থেকে নেমে এসে বছর তিরিশেকের লম্বা, ফরসা একটি ছেলে আমাকে বহনকারী রিকশাটির পথ আগলে দাঁড়ান। এরপর তিনি পেছনে সরে যান। সঙ্গে সঙ্গে আমার বাঁ পাশে মধ্যবয়স্ক গোঁফওয়ালা একজন এসে বলেন, ‘আপনার কাছে এক লাখ টাকা আছে। আমরা এলাকার সন্তান। কখন কার কী বিপদ হয় কিচ্ছু বলা যায় না। যা আছে দ্রুত দিয়ে দেন।’
আমি বলি, ‘আমার কাছে তেমন কিছু নেই।’ মানিব্যাগ বের করে সাড়ে এগারো শ টাকা দেখাই। মানিব্যাগ দেখে ছিনতাইকারী দলের একজন বলেন, ‘ছেড়ে দে, ছেড়ে দে।’এ সময় ডান পাশ থেকে আরেকজন বলা শুরু করে, ‘এই বোমাটা কই। এখনই ফাটাস না।’ এরপর ডান পাশের জন আমার পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় বলেন, ‘পেছনে তাকাবেন না। তাকালে শেষ।’ দেড় মিনিটের মধ্যে ঘটনাটি ঘটিয়ে চলে যায় ছিনতাইকারীরা।
সেই থেকে এই এলাকায় এলেই ভীতি কাজ করে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম ‘সালাম পার্টি’র বেশ কয়েকজন আটক হয়েছেন। যাত্রাবাড়ী এলাকার সাবেক একজন সংসদ সদস্যও জানিয়েছিলেন, তিনি নিজেও সালাম পার্টির কবলে পড়েছিলেন। সান্ত্বনা পেয়েছিলাম!
যখন গুলিস্তান পৌঁছাই, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। অগ্রহায়ণ মাস। সন্ধ্যা নেমেছে আরও অন্তত ঘণ্টাদুয়েক আগে। একদা রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র বলা হতো এই গুলিস্তানকে। ফারসি এই শব্দের অর্থ ফুলের বাগান। এই ফুলের বাগানে সাপ ঢুকেছে বহু আগে। হরেক রকমের প্রতারণা এখানে হতো। অনেক ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি।
তবে প্রতারণা-ছিনতাই ইদানীং কিছুটা কমেছে, এটাই স্বস্তির। এর জন্য অবশ্যই সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে বছরের পর বছর ধরে চলা সচেতনতামূলক মাইকিংয়ের একটা ভূমিকা আছে।
রাত বাড়ছে, ভিড় কমছে, শীতও বাড়ছে। অগত্যা জিপিও অবধি হেঁটে আবার বাসার পথ ধরতে হলো।
সড়ক যতই ভাঙা হোক, যতই হোক ধুলার নগরী, যতই নির্জীব হোক পুরান ঢাকা—তবু এই তো আমাদের শহর। এই শহরে আমরা থাকি, এই শহরেই আমরা বাঁচি। এই শহরে আমরা ‘ছারপোকা হয়ে ছারপোকার পাশে হাঁটি।’
ফিরতে ফিরতে আওড়াই আল মাহমুদের সেই কবিতা—পুরানো ঢাকা। ‘জেট প্লেন স্পর্শ করে মাটি, আবার ঢাকায় আসি। ভিড় ঠেলে হাঁটি। কড়া নাড়ি বদ্ধ দরোজায়, পুরানো ঢাকায়।’
কাজী আলিম-উজ-জামান উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো
ইমেইল: alim. zaman@prothomalo. com