মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা, লাভ একা নেতানিয়াহুর

ইরানের ড্রোন হামলার জবাবে ইসরায়েল পাল্টা হামলার আয়োজন করছে জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করেছিলেন। হোয়াইট হাউসের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাইডেন তাঁকে বলেন, ‘তোমারই তো জয় হয়েছে, তাতেই খুশি থাকো। আর বাড়াবাড়ি কোরো না।’

এই দুই দেশের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার চলতি রাউন্ডে নেতানিয়াহুর একটি নয়—দুটি জয় হয়েছে। ইরানের সামরিক শৌর্য নিয়ে যে গল্প চালু ছিল, তা তিনি মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। একই সঙ্গে নাজুক অবস্থা কাটিয়ে নিজের পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পেয়েছেন।

নেতানিয়াহুই ফাঁদটা পেতেছিলেন। গাজায় জাতি হত্যার অভিযোগে তিনি যখন সারা বিশ্বে নিন্দার সম্মুখীন, এমনকি দেশের ভেতরেও কোণঠাসা, ঠিক তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সবার নজর সরিয়ে নিতে ইরানের ওপর হামলা করবেন। ঠিক ইরান নয়, সিরিয়ায় ইরানের একটি কূটনৈতিক মিশনের ওপর। ২ জন শীর্ষ ইরানি জেনারেলসহ মোট ১২ জন নিহত হন সে হামলায়।

এর জবাবে চুপ করে বসে থাকা ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই মুহূর্তে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে সে এমনটিতেই জেরবার হয়ে আছে। তদুপরি গত ছয় মাসে দেশের ভেতর বড় ধরনের একাধিক বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার একটি আবার সীমান্তের অপর পারে পাকিস্তান থেকে সরকারবিরোধীদের হাতে।

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর ‘সুপ্রিম লিডার’ কে হবেন, তা নিয়েও টানাপোড়েন চলছে। এই অবস্থায় আর যা-ই হোক, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা ইরানের ছিল না।

কিন্তু নিজ কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার পর চুপ করে বসে থাকলে ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনসমর্থন হারাত। খোদ আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি শক্ত জবাবের কথা বলেছেন, ফলে হামলা চালাতে হলো। কিন্তু সে হামলা এমনভাবে চালানো হলো, যেন কারও গায়ে কুটোটিও না লাগে। যুক্তরাষ্ট্রকে আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হলো, ড্রোন ও মিসাইল আসছে। অধিকাংশ ড্রোন ধীরগতিসম্পন্ন, ফলে স্যাটেলাইটে তাদের গতিপথ অনুসরণ খুবই সহজ। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছেও সতর্কবার্তা পৌঁছে গেল।

ইসরায়েলিরা ইরানকে মহাশক্তিধর একটি দেশ ভেবে এত দিন ভীত হয়েছে। কিন্তু সে যে আদতে দুর্বল, কোনো বাধা ছাড়া ইরানের ভেতরে হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহু সে কথা প্রমাণ করলেন। নেতানিয়াহুর জীবনীকার মাজাল মুয়ালেম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘নেতানিয়াহুর কারণেই ইরানের ব্যাপারে আমাদের ভয় কেটে গেছে।’

ইসরায়েলকে কিছু করতে হলো না, তার পশ্চিমা মিত্ররাই ইরানের পাঠানো প্রতিটি মিসাইল টুস টুস করে গুলি করে ভূপাতিত করে ফেলল। পরে জানা গেল, জর্ডান ও আরব আমিরাতও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় হাত লাগিয়েছে। যে শ তিনেক ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল, তার একটাও সে দেশের অভ্যন্তরে পড়েনি। তার আকাশসীমা অতিক্রমের আগেই ৯৯ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে এক বেদুইন বালিকা সামান্য আহত হয়।

এই হামলা-পাল্টা হামলা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিচারিতা লক্ষ করার মতো। সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে তারা টুঁ শব্দ করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব তুলেছিল, কিন্তু যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু ইরান যেই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ড্রোন হামলা চালাল, অমনি তারা হা হা করে উঠল।

মার্কিন কংগ্রেসে দাবি উঠল, বহির্গত হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে আরও অর্থ ও অস্ত্র পাঠানো হোক। সব মিলিয়ে এত দিন যে চাপের মুখে ছিলেন নেতানিয়াহু, তা কাটিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন।

নেতানিয়াহু হিসাব করে দেখলেন, ইরানকে শিক্ষা দেওয়ার এটাই সেরা সময়। তাঁর অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের একাধিক মন্ত্রী দাবি তুললেন, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে খোদ ইরানের ভেতর হামলা চালাতে হবে। এর ফলে সারা মধ্যপ্রাচ্যেই যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে, সে যুক্তিতে পশ্চিমা নেতারা, বিশেষ করে বাইডেন বড় ধরনের পাল্টা হামলা না করতে পরামর্শ দিলেন।

নিজ সরকারের কট্টরপন্থীদের বশে রাখতে নেতানিয়াহু একটি মাঝামাঝি পথ বেছে নেন। নিজ দেশের সীমান্ত থেকে প্রায় দুই হাজার মাইল দূরে ইস্পাহানে ড্রোন পাঠিয়ে যে হামলা তিনি চালালেন, তাতে কোনো হতাহত হলো না, বলার মতো কোনো ক্ষয়ক্ষতিও নেই। কিন্তু ইসরায়েল যে চাইলে অনায়াসে ইরানি আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে পারে, সে কথাও তিনি বেশ বুঝিয়ে দিলেন। অন্যদিকে ইরান বলল, আক্রমণকারী তিনটি ড্রোনই ভূপাতিত করা হয়েছে। এক দিন পর ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিএনএনকে বলেন, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়। আমাদের সামরিক “অপারেশন” শেষ।’

এই যে ইটপাটকেলের লড়াই, তা যে সমানে সমানে নয়, তা বোঝা কঠিন নয়। এই সংঘর্ষ থেকে আবারও প্রমাণিত হলো, ইসরায়েল একা নয়, তার পশ্চিমা ছত্রধারী রয়েছে। শুধু পশ্চিমা দেশগুলোই নয়, একাধিক আরব দেশও ইসরায়েলের পক্ষে ঢাল নিয়ে হাজির। কিন্তু ইরানের পাশে কেউ নেই, কোনো আরব দেশ তো নয়ই, এমনকি চীন ও রাশিয়া, যারা মুখে মুখে সংহতির অনেক কথা বলে, তারাও কুটোটি সরিয়ে দেখেনি। অন্য কথায়, ইরান শুধু সামরিকভাবেই নয়, কূটনৈতিকভাবেও ঠকে গেল।

ইসরায়েলিরা ইরানকে মহাশক্তিধর একটি দেশ ভেবে এত দিন ভীত হয়েছে। কিন্তু সে যে আদতে দুর্বল, কোনো বাধা ছাড়া ইরানের ভেতরে হামলা চালিয়ে নেতানিয়াহু সে কথা প্রমাণ করলেন। নেতানিয়াহুর জীবনীকার মাজাল মুয়ালেম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘নেতানিয়াহুর কারণেই ইরানের ব্যাপারে আমাদের ভয় কেটে গেছে।’

এই ঘটনার পর ফিলিস্তিনিরাও আগের চেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ল। আমরা দেখেছি, গাজা সংকট সামাল দিতে ওয়াশিংটন নতুন করে দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে একটি নীলনকশা প্রস্তুত করেছে, যাতে মাহমুদ আব্বাসের প্যালেস্টাইন অথরিটির অধীনে একটি ‘টেকনোক্রেটিক’ সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই নকশার অধীনে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পাবে একটি বহুজাতিক-মুখ্যত আরব-শান্তিরক্ষা বাহিনী।

নেতানিয়াহু ও তাঁর মন্ত্রিসভার অতি দক্ষিণপন্থীদের অনেকেই এই প্রস্তাবের বিপক্ষে। মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার পর নেতানিয়াহু যে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান প্রশ্নে শুধু তাঁর নিজের শর্তে অগ্রসর হবেন, তাতে সন্দেহ নেই।

● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক