মতামত

‘শনিবার বিকেল’ আটকে লাভটা কার

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তিন প্রজন্মের নির্মাতা ও অভিনয়শীল্পীরা
ছবি: প্রথম আলো

২০১৯ সালের চলচ্চিত্র ‘শনিবার বিকেল’ সেন্সর বোর্ড থেকে সনদ পেয়েই গিয়েছিল, বোর্ডের সদস্যরা গণমাধ্যমকে সে কথা বলেওছিলেন। ২০১৬ সালের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনাকে আশ্রয় করে ছবিটি নির্মিত। তবে ‘দাড়িওয়ালা’ জাহিদ হাসান ও হিজাব পরা তিশার দুটো মাত্র স্থিরচিত্রের বরাতে ধর্মীয় এক গোষ্ঠী অনলাইনে বলা শুরু করে, ছবিটা ইসলামবিরোধী হয়েছে, ছবিটি না দেখেই।

এরপর ছবিটি দ্বিতীয়বার দেখা হয়, সেন্সর সনদ দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয় এবং প্রযোজককে বলা হয়, এ ছবি থেকে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়বে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। কিন্তু পরবর্তী কোনো ব্যাখ্যা বা ফলাফল ছাড়াই ছবিটা বাক্সবন্দী হয়ে আছে তিন বছর ধরে।

সম্প্রতি ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রটি খুব জনপ্রিয় হয়েছে, দেশের বাইরেও চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছে বা পেতে যাচ্ছে। দর্শকপ্রিয় এই ছবির বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০ কোটি টাকার মামলা করেছে বন বিভাগ। অভিযোগ, ছবিটিতে একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে এবং অন্যতম অভিনেতা তাকে হত্যা করে চিবিয়ে খেয়েছে। পাখিটিকে খাঁচায় রাখা হয়েছে, খাওয়ার দৃশ্যও আছে। কিন্তু ওই নির্দিষ্ট পাখিকেই হত্যা করার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, এমন নয়। সৃজনশীলতার স্বাধীনতা নিয়ে চলচ্চিত্রে এ রকম কত কিছু হয়! মানুষ হত্যা করা হয়, বাঘ হত্যা করা দেখানো হয়।

কিন্তু বাস্তবিকই তা করা হয় না। চলচ্চিত্রে মানুষ হত্যা দেখানো নিষিদ্ধ নয়, পাখি হত্যা দেখানোও নিষিদ্ধ কিছু নয়। সত্যিকারের মানুষ, বাঘ বা পাখিকে হত্যা না করলেই হলো। মামলার যা মেরিট, আমার বিশ্বাস—প্রযোজকেরা জিতে যাবেন। ‘হাওয়া’ ছবির প্রযোজক ও পরিচালকের জন্য আমার নৈতিক সমর্থন রইল।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাতারা পাঁচটি দাবি জানিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে—‘হাওয়া’ ছবির বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার; ‘শনিবার বিকেল’ ছবির মুক্তি; সেন্সর বোর্ডে বিলোপ, অংশীজনের সঙ্গে আলাপ সাপেক্ষে আধুনিক ও উদার সার্টিফিকেশন আইন এবং ওটিটি নীতিমালা প্রণয়ন। তবে পঞ্চম দাবিটি আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে, মামলা করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে নিতে হবে—এমন দাবি তাঁরা করেছেন। উটকো মামলা করলে তা তিরষ্কার করা যাবে বা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করে মামলার অসারতা প্রমাণ করা যাবে, মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা যাবে এবং সর্বোপরি আইনি লড়াই করা যাবে।

সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবেন, তাঁর সঙ্গে আলাপ করবেন কোন দুঃখে! তবে চলচ্চিত্রকারদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং কিছু দাবি নিয়ে যৌথভাবে সামনে এগিয়ে আসাকে আমি খুব ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছি। কারণ, এখনকার সময়টাই স্বনিয়ন্ত্রণের, সতর্কতার ও ভীতির এবং শাসকের সঙ্গে আপস করে টিকে থাকার। তাতে ব্যক্তির উপকার হতেও পারে, কিন্তু সার্বিকভাবে নির্দিষ্ট খাতটি ক্রমেই প্রাণহীন ও অনাকর্ষণীয় হতে থাকে। সম্মিলিত অবস্থান গ্রহণ ছাড়া মতপ্রকাশের ন্যূনতম পরিসর রক্ষা করার উপায় নেই।

জানা যাচ্ছে যে হোলি আর্টিজেনের ঘটনা নিয়ে ভারতের পরিচালক হানসাল মেহতা আরেকটি চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন, যা নির্মাণের শেষ স্তরে রয়েছে। দেশের ছবিকে আটকে রেখে কী লাভ, যখন পাশের দেশেই একই বিষয়ে ছবি বানানো হচ্ছে?

কোনো এক আন্তর্জাতিক উৎসবে ‘শনিবার বিকেল’ দেখে ২০১৯ সালেই ‘হলিউড রিপোর্টার’ পত্রিকায় সমালোচক দেবোরাহ ইয়াং ছবিটি নিয়ে লিখেছিলেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে ছবিটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই অভিযোগে যে, এই ছবি দেশটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ বাড়াবে। কিন্তু জার্মানি ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবিটি যে জিনিসটা আসলে করবে তা হলো, দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করবে এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা কমাবে বই বাড়াবে না।’

জানা যাচ্ছে যে হোলি আর্টিজেনের ঘটনা নিয়ে ভারতের পরিচালক হানসাল মেহতা আরেকটি চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন, যা নির্মাণের শেষ স্তরে রয়েছে। দেশের ছবিকে আটকে রেখে কী লাভ, যখন পাশের দেশেই একই বিষয়ে ছবি বানানো হচ্ছে? যে চিন্তা থেকে ভাবমূর্তির দোহাই দেওয়া, তা কি সত্যিই রক্ষা পাবে তখন? আর একটা ছবিকে বছরের পর বছর আটকে রাখার কারণে যেসব সংবাদ জন্ম নেয়, তাতে যে ভাবমূর্তি সত্যি সত্যি ক্ষুণ্ণ হয়, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

অনুমান করি, ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটির পরিচালক সম্প্রতি এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখ খোলেন এবং তা আলোচনার জন্ম দেয়। সম্ভবত অপেক্ষার প্রহর সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এর পরপরই যুক্ত হয় ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের মামলার ঘটনাটি। তাই সেন্সরব্যবস্থা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আলাপটি আবার সামনে চলে এসেছে। আসলে একটি–দুটি চলচ্চিত্রের ব্যাপার নয়। সার্বিকভাবে দেশে মতপ্রকাশের পরিস্থিতি খুবই করুণ দশায় রয়েছে। এই মূল জায়গায় পরিবর্তন না এলে, বারবারই নানান চলচ্চিত্র, বই, গণমাধ্যম নিয়ে সংবাদের জন্ম হতেই থাকবে।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে যোগাযোগ ও মিডিয়া খাতসম্পর্কিত বেশ কিছু নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে কেবল তথ্য অধিকার আইন নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। বাকি সব নীতিমালা ও আইন নিয়েই সংশ্লিষ্ট খাত থেকে মৃদু অথবা জোরালো আপত্তি জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট খাত পেরিয়ে কোনো কোনো নীতিমালা নিয়ে আপত্তি ও বিতর্ক জনপরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮, আইসিটি অ্যাক্ট–২০১৩-এর ৫৭ ধারা, সম্প্রচার নীতিমালা–২০১৪ (খসড়া) ইত্যাদি নিয়ে বিতর্কে সাধারণ জনগণও অংশ নিয়েছে। একদিকে চালু রয়েছে কালাকানুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন–২০১৮ এবং অন্যদিকে বৈশ্বিক গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম, যা গত বছর ছিল ১৫২।

সত্যি বলতে বর্তমান সরকারের সময়ে এই অবস্থান নিচের দিকেই নামছে কেবল, একবারও সূচকের উন্নতি ঘটেনি।

ডিজিটাল মাধ্যম ও মিডিয়া খাতের বাইরে চলচ্চিত্র খাতের পরিস্থিতিও একই রকম। কয়েক দফা সংশোধন করা হলেও সেন্সর বিধিতে ব্রিটিশ উপনিবেশের ভূত সব সময়ই লুকিয়ে ছিল। সবার দাবির মুখে সরকার সার্টিফিকেশন আইন, ২০১৯ (খসড়া) প্রণয়ন করেছে, সেখানে বয়স অনুযায়ী সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কিন্তু সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাহী ক্ষমতায় ছবির প্রদর্শন সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বাতিল করার ক্ষমতা, যা পূর্বের সেন্সর বিধিতে নেই। এই ক্ষমতা মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে (দেখুন উপধারা ৬.১ ও ৬.২)।

পূর্বে কোনো ছবি আটকে গেলে আপিল করা যেত, হাইকোর্টে গিয়ে আদেশ নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, এখন সেসব সুযোগও বন্ধ হবে। আগে ছিল একটি সেন্সর বোর্ড, এখন যেন ৬৪টি সেন্সর বোর্ডের জন্ম হতে চলেছে। তামাশাই বটে!

যখন ওটিটি প্লাটফর্মকে ঘিরে শ্রুতিচিত্র মাধ্যমে এক নবজাগরণ ঘটছে, তখন ওটিটি নীতিমালা ২০২১-এর খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। এখানে এক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কথা বলা আছে যে কর্তৃপক্ষ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে (দেখুন উপধারা ১৬.৬)। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ৮-এর বরাতে কর্তৃপক্ষ ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নজরদারি নিশ্চিত করছে।

চলচ্চিত্র সেন্সরের ইতিহাস হলো সেন্সর বিধি থেকে সার্টিফিকশনে সরে আসার ইতিহাস। অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ দেশে বোর্ড কেবল সনদ ইস্যু করে, সঙ্গে বয়সানুযায়ী একটা র‌্যাঙ্ক দিয়ে দেয়। পরিহাস হলো, আমাদের দেশেও সার্টিফিকেশন আইন হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, র‌্যাঙ্কিং প্রথা আসছে, সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সনদ জব্দ করার ১টি কেন্দ্র ও ৬৪টি উপকেন্দ্র। ‘শনিবার বিকেল’-এর সঙ্গে বিরাট অন্যায় হয়েছে। তাকে আজই মুক্ত করে দিতে হবে।

কিন্তু আলাপটি কেবল একটি ‘শনিবার বিকেল’ বা একটি ‘হাওয়া’র নয়। যেসব নির্মাতা-প্রযোজকেরা বৃহস্পতিবার প্রেস কনফারেন্স করেছেন, তাঁরা যেন সেটা বোঝেন। তাঁদের সেভাবে কাজ করতে হবে। তাঁরা যদি সার্বিকভাবে মতপ্রকাশ পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য কাজ করেন, তবে তার ফলাফল সব খাতের মতো চলচ্চিত্রের লোকজনও পাবেন। তখন কেবল নানা চলচ্চিত্র নিয়ে বারবার কথা বলতে হবে না। পাঁচ নম্বর বাদে, তাঁদের চারটি দাবি, আমারও দাবি—‘শনিবার বিকেল’কে মুক্ত করো; ‘হাওয়া’র মামলা প্রত্যাহার করো; সার্টিফিকেশন আইন থেকে ৬.১ ও ৬.২ উপধারা বাদ দাও; ওটিটি নীতিমালাকে আরও উদার করো।

  • ফাহমিদুল হক চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষক