মতামত

পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ সামরিক ব্যয়ের বিপুল বোঝা

করাচিতে সস্তা বান–কাবাবের দোকানের সামনে দীর্ঘ লাইন
ছবি : রয়টার্স

পাকিস্তানের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দেশটি অনেক দিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ‘বেইল-আউট ঋণ’ চাইলেও সংস্থাটি এমন অনেক কঠোর শর্ত আরোপ করতে চাইছে, যেগুলো পূরণের ক্ষমতা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নেই।

এমনকি পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু চীন ও সৌদি আরবও এখন আর দেশটির দুরারোগ্য ভিক্ষাবৃত্তির ভার নিতে নারাজ। চীনা অর্থে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কিস্তির টাকা বহুদিন ধরে পরিশোধ না করায় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে চীন।

যার কারণে গোটা পাকিস্তান ভয়াবহ লোডশেডিংসহ প্রায়ই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। নাটকীয়ভাবে দাম বেড়ে ১ ডলার এখন ২৭৭ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সমস্যা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে যে এখন ১ কেজি আটার দাম ১৬০ রুপি এবং ১ কেজি চিনির দাম ৩০০ রুপি ছাড়িয়ে গেছে।

সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্র বাহিনীর বোঝা বহন করতে হচ্ছে পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক যুক্তিতে কোনোভাবেই এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয় পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু জন্মশত্রু ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এত বড় সেনাবাহিনী পুষছে তারা। ভারতের সঙ্গে নানা সময়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির প্রকৃত শাসনক্ষমতা ১৯৪৮-৫৮ পর্বে পর্দার আড়াল থেকে এবং ১৯৫৮-৭১ পর্বে সরাসরি সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের করতলগত হয়ে গিয়েছিল।

পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭১-২০২৩ পর্বেও পাকিস্তানের শাসকের ভূমিকা থেকে সামরিক বাহিনীকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুদিন পরপর সামরিক একনায়কেরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করছে। কখনো সিভিলিয়ান শাসকদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও শাসনক্ষমতার প্রকৃত লাগাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দিচ্ছে তারা।

বর্তমান পর্বে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা থেকে শাহবাজ শরিফকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনেও সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের কলকাঠিই আমরা দেখি।

১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।

১৯৪৮ সাল থেকেই পাকিস্তান সরকারের বাজেটের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিরক্ষা খাত, যেখান থেকে গত ৭৫ বছরেও ওই খাতকে সরানো যায়নি। এই অসহনীয় বোঝা যে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে, সে সত্য বিশ্বের সামনে চূড়ান্তভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠছে এবার। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ পাকিস্তানের জনসংখ্যা এখন সাড়ে ২২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এত বড় সশস্ত্র বাহিনীর খায়েশ মেটানোর পর এত বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার জোগান দেওয়া কোনোমতেই পাকিস্তানের কোনো শাসক দল বা জোটের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

দেশটির বার্ষিক রপ্তানি আয় এখনো ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়ে গেছে অথচ আমদানি ব্যয় ৮০ থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৪৭ নম্বরে।

১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিলেন পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম ছিল। অথচ ২০১৫ সালেই মাথাপিছু জিডিপির বিচারে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:

১. মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৮০ শতাংশ এগিয়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৭৯৩ ডলার এবং পাকিস্তানের ১ হাজার ৫৪৭ ডলার।

২. বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

৩. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, গত ১৭ মাসে হ্রাস পেয়ে তা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ালেও সেটা পাকিস্তানের আট গুণের বেশি। (বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার)।

৪. বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।

৫. বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ আর পাকিস্তানের ৫৯।

৬. বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।

৭. বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২, পাকিস্তানের ২ দশমিক ১।

৮. বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে ১ ডলার কিনতে ২৭৭ রুপি লাগে। অথচ ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপির বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল।

৯. বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপির ৪৬ শতাংশ (ওয়াকিবহাল মহলের মতে আরও বেশি)।

১০. বাংলাদেশের নারীদের ৩৬ শতাংশ বাড়ির আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে তা মাত্র ১৪ শতাংশ।

১১. বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ আর পাকিস্তানের ৫৯।

১২. বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

ওপরের তথ্য-উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে শিগগির আর বাংলাদেশের নাগাল পাচ্ছে না। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০-২২ পর্বে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আকার আড়াই লাখের মতো, তবে সরকারি বাজেটে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেক রকম সুবিধা ভোগ করেন।

১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে সামরিক একনায়কেরা বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখল করেছিল, ২০০৭-০৮ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনীই ক্ষমতাসীন ছিল। ওই সময় সরাসরি ক্ষমতা দখলের নানা কারসাজি চালিয়েও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনো অপশক্তি এ ধরনের চেষ্টা করবে না—তা নিশ্চিত করে বলা যাবে কি? বিশেষত, ১৯৯১ সালের পর ২ বছর ছাড়া ৩০ বছর ধরে ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়া যে ‘প্রধানমন্ত্রী-শাসিত সরকারব্যবস্থা’ বাংলাদেশে চালু রয়েছে, তা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মতো মূল সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে দমন করতে পারছে না এবং দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালে ভোটের গণতন্ত্রই লাইনচ্যুত হয়ে গেছে।

  • ড. মইনুল ইসলাম সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়