দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি চালু রাখার বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের একটি অহিংস আন্দোলন দ্রুত সরকারবিরোধী ‘জেন-জি’ বিপ্লবে পরিণত হয়। এই যুব অভ্যুত্থান এমন একটি সমাজে দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠেছে, যে সমাজ আগে থেকেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, দুর্নীতি ও ভিন্নমতের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ ছিল। ছাত্র–জনতার সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ
ইয়েমেনের শান্তিবাদী আন্দোলন কর্মী তাওয়াক্কোল কারমান একবার বলেছিলেন, তারুণ্য একটি বিপ্লব; তাদের থামানো যায় না, তাদের দমানো যায় না এবং তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট কারমানের এই কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। ওই দিন দেশটির স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার আকস্মিক পতন হয়েছে। তাঁর সেই পতন সেখানে কারমানেরই সহযোদ্ধা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’ ঘোষণা করার দিকে পরিচালিত করেছে।
দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালু রাখার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের একটি অহিংস আন্দোলন দ্রুত সরকার বিরোধী জেন-জি বিপ্লবে পরিণত হয়। এই যুব অভ্যুত্থান এমন একটি সমাজে দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠেছে, যে সমাজ আগে থেকেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, দুর্নীতি ও ভিন্নমতের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে সাংঘাতিক ক্ষুব্ধ ছিল।
গত ১৬ জুলাই যেদিন পুলিশ গুলি করে ছাত্রনেতা আবু সাঈদকে হত্যা করে, সেদিনই মূলত হাসিনার চূড়ান্ত পতনের মূল অনুঘটকটির ভিত্তি রচিত হয়ে যায়। আবু সাঈদসহ যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের সবার হত্যার বিচার চেয়ে পরের দিন হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিলেন।
কিন্তু হাসিনার সরকার সে সব হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করে এবং বিক্ষোভ দমনে দলীয় ছাত্র সংগঠনের ক্যাডারদের নামিয়ে দেয়। এ ছাড়া পুলিশের পাশাপাশি সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষীবাহিনী বিজিবি এবং সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে। সরকারের এই হিংসাত্মক পদক্ষেপে বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় হাসিনা বিক্ষোভকারীদের সবাইকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন।
তারপর গত ৪ আগস্ট সরকার নতুন করে ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত এবং রাস্তায় সান্ধ্য আইন জারি করলেও আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করে এবং সেদিনও সংঘর্ষে প্রায় এক শ জন লোক নিহত হয়। কিন্তু ওই দিন দেশটির স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দিন ছিল এবং সেদিনের সেই সহিংসতা এশিয়ার লৌহমানবীর বিরুদ্ধে গণজোয়ারের সৃষ্টি করে।
এর ধারাবাহিকতায় সেনাপ্রধান কারফিউ বলবৎ রাখার সরকারি আদেশ মানতে পারবেন না বলে শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দেন এবং পরের দিন সকালে ঢাকায় শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে বিপুলসংখ্যক জনতা মিছিল নিয়ে আসতে থাকায় হাসিনা পদত্যাগ করেন। অধিকতর রক্তপাত এড়ানোর কৌশল বেছে নেওয়া সেনাবাহিনী দ্রুত শেখ হাসিনাকে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল এবং তারা সরকারের হয়ে কোনো ধরনের কাজ না করে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
আদতে অতি রাজনীতিকৃত কোটা পদ্ধতি হাসিনার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল। গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। দেশে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে সংখ্যক স্নাতক বের হয়েছে, সে পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থতার কারণে লাখ লাখ স্নাতক বেকার জীবন পার করছেন।
জনগণের ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা ও সীমিত সুযোগের বাস্তবতা গোটা প্রজন্মের সামগ্রিক অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়েছে।
হাসিনার আমলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্তরে প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টন হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিক অঙ্গনের যে অভিজাত গোষ্ঠী সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল তারা বেশির ভাগ মুনাফা নিজেদের ঝুলিতে পুরেছে। অন্যদিকে কোটা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দলীয় অনুগতদের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
দেশের বেসরকারি খাত ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত কর্মী বাহিনীকে চাকরি দিতে হিমশিম খাচ্ছিল। কারণ রপ্তানি নির্ভর প্রবৃদ্ধি তৈরি পোশাক খাতের মতো কম দক্ষতানির্ভর খাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। সেখানেও নারী শ্রমিকের অনুপাত কমছে।
বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টি সমন্বয় না করে তার বদলে সরকার একের পর এক বিতর্কিত বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের আকার বেড়েছে, বেসামরিক কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন বেড়েছে এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে।
ব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় এবং স্থবির শ্রমবাজারের ভারে যখন নাগরিকের নাভিশ্বাস উঠছে, তখন হাসিনার শাসন উত্তরোত্তর কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। তিন তিনটি কারচুপির নির্বাচন হাসিনাকে প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় রেখেছে। এই সময়কালে শত শত লোক ‘নিখোঁজ’ হয়েছে। অনেককে রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে আটক করে রাখা হয়েছে।
হাসিনার এই আকস্মিক পতন এখন ইউনূসকে ১৬ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গড়া নতুন সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে এসব অনিয়মের লাগাম টেনে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হলে এই নতুন সরকারকে যুগপৎভাবে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরিয়ে আনা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী ব্যাংকগুলোর সমর্থন নিশ্চিত করা এবং নাগরিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে থাকা বিশাল পরিচিতি, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এনজিও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ব্যবসা প্রসারে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকার সুবাদে মুহাম্মদ ইউনূস এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুসজ্জিত।
তারপরও এটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না, বাংলাদেশ গণতন্ত্রে ফিরবেই। কারণ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের পর (যা একজন নেত্রীর লোক দেখানো নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই ছিল না) কার্যকর নির্বাচনী গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
হাসিনার পলায়নের পরে কয়েক দিন বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। এই সময়টাতে তাঁর দলের কর্মী সমর্থকদের ওপর তীব্র আক্রমণ হয়েছে এবং সারা দেশে নৈরাজ্য হয়েছে। শত শত থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদ ভবনে পর্যন্ত ভাঙচুর হয়েছে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দল প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে— ইতিমধ্যে উদ্বেগজনকভাবে এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, দেশের নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল যিনি হয়েছেন, তিনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একজন সিনিয়র সদস্য।
দেশের মূলধারার কোনো দলই দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নয় এবং সব দল মিলে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি তোলার চেষ্টা করছে যাতে ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন শাসন দীর্ঘ না হয়।
হার্ভার্ড ল স্কুলের নোহ ফেল্ডম্যান যেমন আরব বসন্তকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘আরব শীত’ বলে অভিহিত করেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণও অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে আশার কথা হলো, একটি হতাশাজনক পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠার মতো অবস্থা থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে।
আরব বিশ্বের গণ-অভ্যুত্থান আংশিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ সেখানকার রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এই জেনারেশন-জেড (জেন-জি) আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একজন স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েই থেমে যায়নি। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার আগে সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং বয় স্কাউটরা ট্রাফিক পুলিশ, নগর পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মীর দায়িত্ব পালন করেছে।
এর চেয়ে হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য আর কী হতে পারে যেখানে মাদ্রাসার ছাত্রদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশি তরুণেরা চলমান রাজনীতির ওপর নজর রাখছেন। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তার জন্য তাঁরা একটি নীতি কাঠামো তৈরি করছেন। তাঁরা সুশাসন ও একটি যোগ্যতাভিত্তিক সমাজ গড়ার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছেন।
সেনাবাহিনী বা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে তাঁরা ইউনূসকে দায়িত্ব নিতে রাজি করিয়েছেন। হাসিনার রাবার-স্ট্যাম্প সংসদ ভেঙে দেওয়ার এবং ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নেতৃত্ব নির্বাচনে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক পন্থা অবলম্বন করেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতাকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করা হয়েছে।
এসব দেখে মনে হয়, যত দিন দেশের অভিজাত শ্রেণি এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নেবে এবং যত দিন এই তারুণ্যের আন্দোলন তাদের আদর্শ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে ততদিন ‘বাংলা বসন্ত’ চলবে।
এম. নিয়াজ আসাদুল্লাহ মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব রেডিংয়ের অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও গ্লোবাল লেবার অর্গানাইজেশনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ক্লাস্টারের প্রধান।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ