মতামত

‘দুর্বল ও অপমানিত’ পুতিন ছাড়া সি চিন পিংয়ের গতিও নেই

সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে তাঁর ‘সীমানাহীন’ অংশীদারির ঘোষণা দেওয়ার দিন কয়েক পরই পুতিন ইউক্রেনে অভিযান চালিয়েছিলেন
ছবি: এএফপি

ক্রেমলিনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে গত ২৯ জুন বৈঠক করার পর ভাগনার গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন সম্ভবত তাঁর করণীয় দায়িত্ব পালন করা শুরু করেছেন। তবে পুতিন ও প্রিগোশিনের মধ্যে মিলমিশ হয়েছে বলে ক্রেমলিনের দিক থেকে ধারণা দেওয়া হলেও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মাথা থেকে সহসাই এই ধারণা উবে যাচ্ছে না যে, প্রিগোশিনের গত মাসের বিদ্রোহ রাশিয়ার নেতৃত্বকে চোখে পড়ার মতো দুর্বল করেছে।

ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ এবং লড়াইয়ে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি পুতিনের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের ‘সীমানাহীন’ অংশীদারিকে এখন চীনের ঘাড়ে সামরিক দায়বদ্ধতার বোঝায় পরিণত করেছে।

চীন জোর দিয়েই বলছে, ভাগনার গ্রুপের অভ্যুত্থানচেষ্টা ক্রেমলিন–বেইজিং সহযোগিতাকে হুমকিতে ফেলেনি। প্রিগোশিন তাঁর মস্কো অভিযান থামানোর কয়েক ঘণ্টা পরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ভাগনার বিদ্রোহের ঘটনাকে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। চীনের অভ্যন্তরে প্রিগোশিনের বিদ্রোহের খবরাখবরও বিরল ছিল; কারণ পুতিনকে নামিয়ে দেওয়া হতে পারে এমন যে কোনো খবরকে নজরদারি কর্তৃপক্ষ সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিল।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রাশিয়ার প্রতি চীন সরকারের সমর্থনের কথা আবারও জোর দিয়ে বলে যাচ্ছে। তারা ভাগনার বিদ্রোহের ঘটনায় পশ্চিমা প্রতিক্রিয়াকে অতিরঞ্জিত হিসেবে দেখিয়েছে। একইসঙ্গে পুতিনের অবস্থানকে তারা সুরক্ষিত ও নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে। বোঝা যাচ্ছে, সি চিন পিং তাঁর নিজের মুখরক্ষা করে চলবেন এবং চীনের সঙ্গে রাশিয়ার ও তাঁর সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বকে অটুট হিসেবে দেখাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।

গত এক দশকে এই দুই নেতা প্রায় চল্লিশবার দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন এবং বিশ্বরাজনীতির বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁদের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে আসছেন।

সি চিন পিং পুতিনের সঙ্গে তাঁর ‘সীমানাহীন’ অংশীদারির ঘোষণা দেওয়ার দিন কয়েক পরই পুতিন ইউক্রেনে অভিযান চালিয়েছিলেন। গত মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার তিন দিনের মাথায় বেইজিং পুতিনের সঙ্গে করমর্দনরত সি চিন পিংয়ের ছবি প্রকাশ করে দুই দেশের সম্পর্ক অটুট আছে বলে বার্তা দিয়েছে।

চীন যে বহুমেরুর বিশ্বের স্বপ্ন দেখে সেখানে তার পথে সবচেয়ে বড় বাধা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা। আর এই মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমকে বাধাদানের চাবিকাঠি হলো রাশিয়া।

গত মার্চে সি এবং পুতিন ‘বিশদ কৌশলগত অংশীদারির’ যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা ডলারের ব্যবহার এড়িয়ে বিনিময় ব্যবস্থা চালুতে পারস্পরিক সহযোগিতা করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। পাশাপাশি ইরান, সিরিয়া ও আফ্রিকা বিষয়ে দুই দেশের সমান্তরাল নীতি অনুসরণের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিণতির কথা জানা সত্ত্বেও সি বলেছিলেন, চীন ও রাশিয়ার পরস্পর নির্ভরশীল কৌশল ‘কোনো ঘটনার কারণে বদলাবে না... এই যুদ্ধে আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট কতটা অদল-বদল হবে তা ধর্তব্যে পড়বে না।’ সি তাঁর নিজের দেশের ভেতরে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ আছেন। সর্বোপরি প্রবল মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠা চীনা অর্থনীতির স্বার্থেই রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক জোরালো করা দরকার।

ক্ষতির মুখে পড়া শিল্পোৎপাদন, দুর্বল ভোক্তা-চাহিদা এবং রপ্তানি কমে যাওয়া চীনের কোভিডোত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও চীনের মোট বাণিজ্যের মাত্র ৩ শতাংশ রাশিয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে; তথাপি দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আগের তুলনায় ২০২২ সালে ৩০ শতাংশ বেড়েছে এবং গত মে মাসে সেই বৃদ্ধির হার ৪১ শতাংশে উঠেছে। চীন ব্যাপক মূল্যছাড়ে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কিনছে। অন্যদিকে চীনের রপ্তানিপণ্য যুদ্ধে টিকে থাকা ও অর্থনীতিকে জাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে বড় ধরনের সহায়তা করছে।

উপরন্তু সি চীন-রাশিয়া সামরিক সহযোগিতায় গভীর মনোযোগী হয়েছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার এবং পূর্ব ইউক্রেনে ঢুকে পড়ার পর সি চিন পিংয়ের উদ্যোগে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক অধিকতর জোরদার করা হয়, যদিও এর জের ধরে বেইজিংকে অনেকগুলো নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়েছে।

যদিও ২০২০ সাল থেকে চীন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে, তবে চীন এখনো রাশিয়ার উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে, রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক কৌশল ও জ্ঞান আদান প্রদান করে, যৌথ মহড়া চালিয়ে এবং উচ্চ প্রযুক্তির বিমান, নৌ ও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে উপকৃত হচ্ছে।

পুতিনের ব্যর্থতার মূল কারণগুলো এখন সি চিন পিংকে ব্যক্তিগতভাবে সমস্যায় ফেলবে। এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে থাকা চেইন অব কমান্ড এবং ইউক্রেনে ক্রমাগত রুশ জেনারেলদের রদবদলের কথা বিবেচনা করুন। তাদের অবস্থা দেখে চীনের সামরিক গোষ্ঠী রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া দেওয়ায় কতটা আশাবাদী হবে তা ভাবার বিষয়।

তবে এই সব সুবিধার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান দায়বদ্ধতার বিষয়টিকেও বেইজিং উপেক্ষা করতে পারছে না। ১৬ মাসের লড়াইয়ে রাশিয়ার ব্যর্থতার পর দেখা যাচ্ছে, রুশ বাহিনী তাদের লড়াই চালানোর ক্ষমতার ৫০ শতাংশই হারিয়ে ফেলেছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত রুশ সেনাদের হতাহতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধের এই ফল দেখে চীনের জেনারেলরা যে হতবাক হয়েছেন এবং হতাশ হয়েছেন, এমন ধারণা করা যেতেই পারে। চীন আশা করেছিল, ইউক্রেনে রাশিয়ার জয় হবে এবং সেই বিজয়ী পটভূমিতে বেইজিং নতুন একটি রূপরেখা আঁকবে। কিন্তু তাদের সেই আশা  ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

পুতিনের ব্যর্থতার মূল কারণগুলো এখন সি চিন পিংকে ব্যক্তিগতভাবে সমস্যায় ফেলবে। এই প্রসঙ্গে রাশিয়ার নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে থাকা চেইন অব কমান্ড এবং ইউক্রেনে ক্রমাগত রুশ জেনারেলদের রদবদলের কথা বিবেচনা করুন। তাদের অবস্থা দেখে চীনের সামরিক গোষ্ঠী রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া দেওয়ায় কতটা আশাবাদী হবে তা ভাবার বিষয়।

সির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়ার এলোমেলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা শুধুমাত্র লড়াইয়ের ময়দানেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্ট-এর গবেষক মিখাইল কোমিন বলেছেন, প্রিগোশিনের বিদ্রোহের পর রুশ সেনাবাহিনীর নিস্পৃহ প্রতিক্রিয়া সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্যকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

সি নিজে এই সমস্যার সঙ্গে পরিচিত। ২০১০-এর দশকে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া উচ্চপদস্থ অনেক সেনা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। সমালোচক ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখে কুলুপ এঁটে দিতেই তিনি এই শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন। যখন ভাগনার গ্রুপ মস্কো দখলের হুংকার দিয়ে সামনে এগোচ্ছিল এবং রুশ সেনাবাহিনী কিছু না করে দাঁড়িয়েছিল, তখন সি চিন পিংয়ের মনের মধ্যে কী ঘটছিল তা যে কাউকে ভাবাবে।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, প্রিগোশিন এবং তিনি যাঁদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন—সেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভালেরি গেরাসিমভ সম্পর্কে চীনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, অবস্থান এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য ক্রেমলিনের ভেতরে নিজেদের মধ্যে লড়াই করা অনেক খেলোয়াড়ের মধ্যে এরা ছাড়াও অনেকে আছেন। রাশিয়ার চেইন অব কমান্ডের এই প্রশ্নবিদ্ধ অখণ্ডতা সির কৌশলগত হিসাব নিকাশ ও বৈশ্বিক নকশাকে মৌলিকভাবে বদলে দেবে কিনা তা বিবেচনার বিষয়।

প্রিগোশিনের বিদ্রোহের পরে রাশিয়ার কমপক্ষে ১৩ জন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে এবং ১৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত কিংবা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই বিষয়টি বেইজিংয়ের জন্য বিরক্তিকর বিষয় হতে পারে। তবে আপাতত মনে হচ্ছে, দুর্বল ও অপমানিত পুতিন ছাড়া সির গতিও নেই।

  • সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
    ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    কেন্ট হ্যারিংটন প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ সিআইএ বিশ্লেষক যিনি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটির এশিয়া স্টেশন প্রধান ও সংস্থাটির জনসংযোগ বিষয়ক পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।