মতামত

চীনের ভেতরের অবস্থা মার্কিন গোয়েন্দারা কতটুকু জানেন

হোয়াইট হাউসের মতো আইসি পর্যবেক্ষণও গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং চীনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে হুমকি হিসেবেই দেখতে হবে।
ছবি : রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি (আইসি) তাদের ২০২৩ সালের সম্ভাব্য হুমকিবিষয়ক যে বার্ষিক প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটিকে হালকা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। চীনের উত্থান, রাশিয়ার আগ্রাসন এবং ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন, ভবিষ্যৎ মহামারি এবং সংগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তারা যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, তা গভীর উদ্বেগজনক।

কংগ্রেস এবং মার্কিন জনগণের কাছে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুই দশক আগে থেকে আইসি এ ধরনের বার্ষিক পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। তবে রেওয়াজ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জাতীয় হুমকি সম্পর্কে সেখানে বলা হয়ে থাকে এবং প্রতিবেদনের সূত্র ও তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদভাবে বলা হয় না।

তবে ৮ মার্চ সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক অ্যাভ্রিল হেইনস খুব একটা রাখঢাক করেননি। সেখানে তিনি খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন চীনকে ‘অতুলনীয় চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে মনে করছে। একই সঙ্গে ওয়াশিংটন চীনকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকি বলে বিবেচনা করছে।

হোয়াইট হাউসের মতো আইসি পর্যবেক্ষণও গুরুত্ব দিয়ে বলেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের যুদ্ধংদেহী মনোভাব এবং চীনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে হুমকি হিসেবেই দেখতে হবে। তবে চীনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো এবং সি চিন পিংয়ের সরকারের জন্য সেই সমস্যাগুলো কতটুকু প্রভাবকের কাজ করে, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের জানাবোঝার খামতি আছে।

আমরা মনে করি, চীনের এ সব বিষয়ে আইসির আরও গভীরভাবে তলিয়ে দেখা দরকার। সি চিন পিংয়ের চীনে কী কী ঘটছে, তা মার্কিন কংগ্রেস ও জনগণের বিশদ জানা দরকার। কারণ, এখন পর্যন্ত আমরা যা জানছি, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আর অভ্যন্তরীণ থাকছে না। এর সঙ্গে আমরা সবাই জড়িয়ে আছি।

কয়েক দশক ধরে বেসরকারি পর্যায়ে বিশাল বিনিয়োগ পাওয়া সম্পত্তি ও আবাসন খাতকে সি চিন পিং যেভাবে পুনর্গঠন করতে চাইছেন, সে বিষয়টির দিকে তাকান। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডোমেন্টের গবেষক মাইকেল পেট্টিসের মতে, এই খাতে চীনের জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ ঢালা হয়েছে, কিন্তু খাতটি বর্তমানে ঝুলে গেছে এবং খাতটির অর্জন শ্লথ হয়ে এসেছে।

দুই বছর আগে বৃহৎ পুঁজির আবাসন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সরকার অর্থনৈতিক ক্র্যাকডাউন শুরু করে। এর ফলে কোটি কোটি ডলারের অনেক আবাসন কোম্পানিগুলো ঋণখেলাপি হয়ে যায় এবং অনেক শহরের আবাসন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নির্মাণকাজ দীর্ঘ মেয়াদে ঝুলে যায়।

অনেক বড় বড় আবাসন কোম্পানি এখনো টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। চীনের সরকারিভাবে পরিসংখ্যানের তথ্যে অনেক লুকোছাপা থাকে। কিন্তু সেই তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, তাদের আবাসন খাত বিপর্যয়ের মুখে আছে। ৩১টি প্রদেশ আবাসনে তহবিল সরবরাহের জন্য ৫.১ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। স্থানীয় সরকারগুলোকে এ বছর বকেয়া বন্ড বাবদ ৭৯ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এ অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন, পেনশন, পরিষেবা ও স্বাস্থ্যসেবায় কোপ পড়ছে।

এসব নাগরিক সুবিধা সংকুচিত হওয়ার ফলে চীনের বেশ কিছু শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। শুধু শ্রমিক ও পেনশনভোগীরাই যে সেই বিক্ষোভ করছেন, তা নয়। দেশটির যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তারাও এ ক্ষোভে শামিল হয়েছে।

এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের সরকার আবাসন খাতকে আবার চাঙা করার জন্য গত নভেম্বরে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং গত জানুয়ারিতে আবাসন খাতে ১৬ মাস ধরে চলা পতনের ধারা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু প্লট-ফ্ল্যাটের সম্ভাব্য ক্রেতারা এখনো শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। এখনো অনেক প্রকল্প নির্জীব অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

এটি ঠিক যে ক্রমবর্ধমান যুব বেকারত্ব ও শ্রমশক্তির সংকোচন থেকে শুরু করে আবাসন খাতের মতো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সি চিন পিংয়ের শাসনের সামনে অব্যবহিত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে না।

কিন্তু তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এগুলো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। জিরো কোভিড নীতি অনুসরণের প্রতিবাদে গত বছর বড় ধরনের বিক্ষোভের পর চীনা কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েছেন। সি চিন পিংয়ের অধীনে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) সরকারের মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে প্রতিনিধি পাঠানো বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি–বেসরকারি তথ্যের আদান–প্রদানের বিধিবিধান কড়া করছে।

আমরা মনে করি, চীনের এ সব বিষয়ে আইসির আরও গভীরভাবে তলিয়ে দেখা দরকার। সি চিন পিংয়ের চীনে কী কী ঘটছে, তা মার্কিন কংগ্রেস ও জনগণের বিশদ জানা দরকার। কারণ, এখন পর্যন্ত আমরা যা জানছি, চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো আর অভ্যন্তরীণ থাকছে না। এর সঙ্গে আমরা সবাই জড়িয়ে আছি।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • কেন্ট হ্যারিংটন সিআইএর সাবেক সিনিয়র সিআইএ বিশ্লেষক