বাংলাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে ‘উন্নত’ দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এই সবই ভালো। কিন্তু বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম নিরসনের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, আমাদের দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশু রয়েছে ৩৫ লাখ ৪০ হাজার। ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু নিয়োজিত রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।
‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ জানাচ্ছে, ২০২৩ সালে ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে তাদের বাল্যবিবাহ এবং ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে বাধ্য করে আমাদের উন্নয়ন কি অর্থপূর্ণ হবে?
বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমের কারণে শিশুরা পড়াশোনা করতে পারে না, তাদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়। এসব প্রথা আমরা যেন সামাজিকভাবে গ্রহণ করে নিয়েছি। এ ছাড়া শিশুরা নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। আমরা এখনো এসব সমস্যার সমাধান করতে পারিনি। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন ধরনের শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
অনলাইনে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মা-বাবা সন্তানের জীবনের ব্যক্তিগত তথ্য এবং ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে শিশুদের ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। ফাস্ট ফুডের অনিয়ন্ত্রিত প্রসার এবং পরিবেশদূষণ শিশুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি বাংলাদেশের সব আর্থসামাজিক অবস্থার শিশুর জন্য উদ্বিগ্ন।
যেসব শিশু আর্থিক প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হচ্ছে, তারাও কি বিকাশের উপযোগী পরিবেশ পায়? বেশির ভাগ মা-বাবা ও অভিভাবকদের মধ্যে শিশু বিকাশের পর্যায় নিয়ে ধারণা অত্যন্ত কম। নানা বয়সের শিশুদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি আলাদা। বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনা তাদের পরিপূর্ণ বিকাশে ভূমিকা রাখে। এই বিষয়গুলো না জানলে শিশুদের বেড়ে ওঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়।
ধরা যাক, মা-বাবা চার বছরের সন্তানের জন্য খুব দামি যান্ত্রিক গাড়ি খেলনা হিসেবে কিনলেন। এই বয়সে যন্ত্রচালিত খেলনা শিশুর বিকাশে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে না, কারণ এ ক্ষেত্রে সে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে। বরং গাড়িটি যে কার্ডবোর্ডের বাক্সে আছে, সেই কাগজ বা অন্য যেকোনো সাধারণ উপাদান দিয়ে কিছু সৃষ্টি করা শিশুটির বেড়ে ওঠায় সহায়ক হবে। এ ক্ষেত্রে সে নিজের কল্পনা কাজে লাগিয়ে কিছু তৈরি করতে পারছে, যা মস্তিষ্কের গঠনে প্রয়োজন।
সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করে তোলা শিখতে হয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মা-বাবা এটা জানেন না বা মানেন না। আর যাঁরা শিখতে চান, তাঁরা শেখার সুযোগ পান না। সন্তান জন্মের আগে এবং পরে যখন মা-বাবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান, তখন শিশুদের জীবনের নানা ধাপ এবং বিকাশে করণীয় নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের জানাতে পারেন।
গণমাধ্যমে জনস্বার্থেই এ ব্যাপারে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। শিশুর পুষ্টি, টিকাদান ইত্যাদি নিয়ে আগের চেয়ে সামাজিক সচেতনতা বেড়েছে, যা প্রয়োজনীয়। কিন্তু শুধু শারীরিক বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়—বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগীয় উদ্দীপনা না পেলে শিশুদের বিকাশ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ইদানীং অনেক মা-বাবার শিশুদের সময় দিতে অনীহা রয়েছে। হয়তো শিশুটি আগ্রহভরে মা অথবা বাবার কাছে এসেছে, কোনো প্রশ্ন করছে অথবা কিছু জানাতে চাইছে। তিনি কিন্তু শিশুকে উপেক্ষা করে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত।
গবেষণা জানাচ্ছে, বারবার অবহেলা মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতায় পরিবর্তন আনতে পারে। উদ্দীপনা ও যত্নের অভাব শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে। সন্তানদের দামি জামাকাপড়, খেলনা কিনে দিয়ে আর মাঝেমধ্যে রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে গিয়ে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শিশুদের প্রয়োজন মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সময় ও মনোযোগ।
আমরা প্রায়ই বলি, ‘মা-বাবা সন্তানদের সবচেয়ে ভালো চান।’ তাহলে পরিবারের কোনো সদস্যের দ্বারা সন্তান যৌন নির্যাতনের শিকার হলে বেশির ভাগ মা-বাবা তা গোপন করেন কেন? তাঁদের দায়িত্ব তো সন্তানের পক্ষে দাঁড়ানো, তাকে সহায়তা করা, নির্যাতনকারীর বিচারের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তাঁরা তথাকথিত ‘পারিবারিক সম্মান’ রক্ষার কারণে এসবের কিছুই করেন না।
বিবাহবিচ্ছেদের সময় অনেক মা-বাবা নিজেদের হতাশা উগরে দিচ্ছেন সন্তানদের ওপর, কখনো–বা সন্তানকে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করছেন। তিক্ত বিবাহবিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। কারণ, এ ক্ষেত্রে অনেক মা-বাবা নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখেন। সন্তানদের ভালো চাইলে কি তারা এ রকম আচরণ করতেন?
‘শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ’—এ কথা আমরা অহরহ বলি, কিন্তু আমরা কি এতে বিশ্বাস করি? করলে তাদের খেলার মাঠগুলো ধ্বংস করছি কেন? শিশুদের বর্তমানটা সুন্দর করে তাদের বিকাশ নিশ্চিত না করলে তারা কী ধরনের ‘ভবিষ্যৎ’ জাতিকে দিতে পারবে? উন্মুক্ত স্থানগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে নিচ্ছে এবং সেখানে শিশুরা আর প্রবেশ করতে পারছে না।
পাশাপাশি মেলা, হাট ও নানা ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য খেলার মাঠ ইজারা দেওয়া হয়। অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যেখানে আমরা কিসে শিশুদের ভালো হবে তা চিন্তা না করে নিজেদের সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। সে জন্যই করোনা মহামারির সময় বৈশ্বিক পর্যায়ের দিকনির্দেশনা এবং বিভিন্ন দেশের উদাহরণ উপেক্ষা করে আমরা দুই বছর বিদ্যালয় বন্ধ রেখেছি, শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।
সব শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও অংশগ্রহণের অধিকার আছে। আমাদের দায়িত্ব এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে শিশুরা পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। শিশু সংবেদনশীল হওয়া একটা মানসিকতা, যেকোনো পরিস্থিতিতে তা বজায় রাখা সম্ভব।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইন এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে শিশুদের চোখ দিয়ে নানা বিষয় বিবেচনা করে তাদের মঙ্গলের জন্য আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী