মতামত

ইরানি মেয়েদের টুপিতে আরেকটি পালক

ইরানি মেয়েরা টলেননি। তাঁরা রাস্তাও ছেড়ে দেননি। অবশেষে মাথা নুইয়েছে সরকার
ছবি: রয়টার্স

এ বছর মে মাসে আফসানে হোশামইফ্রিদ এভারেস্টের পর্বতশৃঙ্গে পা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, আমি মুক্ত, এখন আমি উড়ে যেতে পারি। তিনি ছিলেন প্রথম ইরানি নারী, যে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেন। তাঁর সে বিজয়ের এক সপ্তাহের মাথায় সেই একই শৃঙ্গে পা রাখেন এলহাম রামেজানি, তিনি দ্বিতীয় ইরানি নারী, যঁার পক্ষে এভারেস্ট বিজয় সম্ভব হয়। 

কীভাবে সম্ভব হলো এই বিজয়? আফসানে ও এলহাম উভয়েই বলেন, ‘এটি ছিল আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। স্বপ্ন দেখে বসে থাকিনি, আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছি। তারপরই বিজয় এসেছে।’

এভারেস্ট জয়ের ছয় মাসের মাথায় আরেকটি অসম্ভব সম্ভব করেছেন ইরানি মেয়েরা। তিন মাস ধরে সে দেশের মেয়েরা লড়াই করছেন মাথার চুল ঢেকে রাখার বাধ্যতামূলক আইনের বিরুদ্ধে। এ বছর সেপ্টেম্বরে ২২ বছর বয়স্ক ইরানি-কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি মাথা ঢেকে না রাখার অপরাধে ইরানের ‘নীতি পুলিশে’র হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পরে পুলিশি তত্ত্বাবধানে থাকার সময় নিহত হন। সে ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে অভাবিত বিক্ষোভ দেখা দেয়। শুধু রাজধানী তেহরান নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরাও রাস্তায় নেমে আসেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী কয়েক শ বিক্ষোভকারী পুলিশের হাতে নিহত হন। গ্রেপ্তার হন অসংখ্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হলো এটি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র, তাদের মদদেই এই বিক্ষোভ। কঠোর হাতে রাষ্ট্রবিরোধী সব তৎপরতা ঠেকানো হবে। আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

ইরানি মেয়েরা টলেননি। তাঁরা রাস্তাও ছেড়ে দেননি। অবশেষে মাথা নুইয়েছে সরকার। ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল জাফর মোন্তাজেরি জানিয়েছেন, ‘নীতি পুলিশ’ ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে। মাথা ঢেকে রাখা না রাখার অপরাধে গ্রেপ্তারের যে এখতিয়ার এই পুলিশের ছিল, তা বাতিল করা হবে। চুল ঢেকে রাখার যে আইন ইরানে চালু রয়েছে, তা বাতিলের বিষয়টিও বিবেচনাধীন।

ইরানের ইসলামি সরকার যে শেষ পর্যন্ত তাদের হিজাব আইন বদলাতে বাধ্য হচ্ছে, তার কারণ শুধু মেয়েদের অনড় অবস্থাই নয়। একটা বড় কারণ, বয়কটের ফলে তাদের পকেটের নাজুক অবস্থা। এমনিতেই ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি বেহাল। তার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষমতাসীন মহলের হাতের মুঠো একটু হলেও শিথিল হয়। নীতি পুলিশ প্রত্যাহারের এই ‘কনসেশন’ সে অবস্থা মোকাবিলায় মরিয়া এক চেষ্টা মাত্র। 

রাষ্ট্রের হাতে নির্যাতনের জন্য হাতিয়ারের অভাব নেই। তাদের পুলিশ রয়েছে, বিক্ষোভ দমনে বিশেষ গার্ড রয়েছে, রয়েছে ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র, এমনকি ট্যাংক। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের রয়েছে ক্ষমতাধর ধর্মগুরুদের ফতোয়া ও রাজনীতিকদের রক্তচক্ষু। কিছুতে কাজ হয়নি। নিরস্ত্র মেয়েদের প্রতিবাদ ধ্বনির সামনে পিছু হঠতে বাধ্য হলো তারা সবাই।

মাসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে যে বিক্ষোভ, তাকে যদি শুধু হিজাব পরা না–পরার লড়াই ভাবা হয়, তাহলে ভুল করা হবে। এটি ছিল অতিরক্ষণশীল একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর অসহনীয় নিবর্তনের বিরুদ্ধে সে দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ। শুধু হিজাব নয়, সব গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতেই সে দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। আমরা কথা বলার অধিকার চাই, রাস্তায় একে অপরের হাত ধরে হাঁটার অধিকার চাই, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির অবসান চাই, স্বাভাবিক মুক্তজীবনের অধিকার চাই। ‘বারোইয়ে’ নামের একটি গান, যা ইরানি মেয়েদের করা টুইটের ভিত্তিতে রচিত হয়, তাতে এই অধিকারের ধ্বনিই উঠে এসেছে। (প্রথম আলোতে সে গানটির একটি অনুবাদ এখানে দেখে নিন <https://www. prothomalo.com/onnoalo/buvigox1 zw>)। 

হঠাৎই বা রাতারাতি ইরানি মেয়েরা এই বিজয় অর্জন করলেন, তা কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন থেকে তাঁরা সমানাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ জানিয়ে আসছেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম অংশীদার ছিলেন সে দেশের মেয়েরা। শাহের একনায়কতন্ত্র ও নিবর্তনের তাঁরাও সাক্ষী। ইসলামি বিপ্লবের সাফল্যের পর মেয়েরা আশা করেছিলেন এই বিপ্লবের সুফল তাঁরা ভোগ করবেন, তাঁরা সমানাধিকার অর্জন করবেন। বাস্তবে ঘটল উল্টো, ক্ষমতায় এসেই ধর্মগুরুরা মেয়েদের অধিকার টেনে ধরলেন। আইন পরিষদে পাস হলো চুল ঢাকার নতুন আইন, সেই আইন বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হলো নীতি পুলিশ। তখন থেকেই মেয়েরা আয়াতুল্লাহদের এই চেষ্টার প্রতিবাদ করে এসেছেন। ৯০-দশকের মাঝামাঝি সে দেশে আমরা প্রথম দেখলাম ‘গোলাপি বিপ্লব’ (পিঙ্ক রেভল্যুশন)। মাথায়, সারা গায়ে চাদর জড়ানোর আইন না ভেঙে সেই আইনকে উপহাস করতে তাঁরা ইচ্ছা করে অতিরিক্ত মেকআপ নিয়ে রাস্তায় নামলেন। রংবেরঙের চাদর পরা শুরু করলেন, চোখে সানগ্লাস, হাতে ফ্যাশন দুরস্ত হাতব্যাগ। স্বাভাবিকভাবেই নীতি পুলিশ বাগড়া দিতে এল, কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক মেয়ে এই বিপ্লবে অংশ নেন যে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই রণে ভঙ্গ দেন।

পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে ধর্মগুরুদের নৈতিক অনুশাসনের বিরুদ্ধে ইরানি মেয়েরা আরেক অভিনব প্রতিবাদ শুরু করেন। ‘বুধবার সাদা পোশাকে প্রতিবাদ’ নামে পরিচিত সে আন্দোলনে মেয়েদের এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় পুরুষেরা সাদা পোশাক পরা শুরু করলেন। মেয়েরা প্রথাগত হিজাব বা চাদরের বদলে সাদা স্কার্ফ পরে রাস্তায় দল বেঁধে নেমে আসেন। এরপর সে স্কার্ফ খুলে খোলা চুলে হাঁটা শুরু করেন। ছেলেরাও সাদা জামা-প্যান্ট পরে মেয়েদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। সে আন্দোলনের একটি ছবি এখনো অনেকের মনে গেঁথে আছে। ভিদা মোহাভেদ নামের এক তরুণী তেহরানের বিপ্লব চত্বরে দাঁড়িয়ে নিজের সাদা স্কার্ফ খুলে সগর্বে তা দোলাতে থাকেন। হাজার হাজার মানুষ তাঁকে সহর্ষে অভিনন্দন জানান। এই অবাধ্য আচরণের জন্য মোহাভেদের এক বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। 

মেয়েরা কট্টর নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অধিক সহনীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনেও অংশ নেন। ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভের সময় নেদা আগা সোলতান নামের এক তরুণীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালে সংস্কারপন্থী হাসান মুসাভির বিপুল ব্যবধানে বিজয়ের পেছনে একটি বড় ভূমিকা ছিল দেশের মেয়েদের। সে সময় ‘আইন পরিষদে ১০০ নারী’ এই আন্দোলন সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

মাসা আমিনির হত্যার পর ইরানে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটি গুণগত ভিন্ন। এই আন্দোলন শুধু মেয়েদের নয়, দেশের সব মানুষের—ফলে মেয়েরা শুরু করলেও ক্রমেই তাতে যুক্ত হয়েছে সমাজের অন্যান্য অংশ। নাগরিক বিক্ষোভ অথবা শিক্ষা ও কর্মবিরতি ছাড়াও প্রথমবারের মতো বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা দেশজুড়ে ধর্মীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের লেঠেল হিসেবে পরিচিত বিপ্লবী গার্ডের মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেয়। বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য পণ্য, যার উৎপাদনের সঙ্গে বিপ্লবী গার্ডের মালিকানা রয়েছে, দেশজুড়ে তা প্রত্যাখ্যানের আন্দোলন গড়ে ওঠে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে ওঠে, যে অনলাইন সংস্থাটি এসব পণ্যের বাজারজাতকরণে নিয়োজিত ছিল, তারা ঘোষণা দিয়ে বলতে বাধ্য হয় যে না এসব পণ্যের মালিকানার সঙ্গে বিপ্লবী গার্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। 

ইরানের ইসলামি সরকার যে শেষ পর্যন্ত তাদের হিজাব আইন বদলাতে বাধ্য হচ্ছে, তার কারণ শুধু মেয়েদের অনড় অবস্থাই নয়। একটা বড় কারণ, বয়কটের ফলে তাদের পকেটের নাজুক অবস্থা। এমনিতেই ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি বেহাল। তার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষমতাসীন মহলের হাতের মুঠো একটু হলেও শিথিল হয়। নীতি পুলিশ প্রত্যাহারের এই ‘কনসেশন’ সে অবস্থা মোকাবিলায় মরিয়া এক চেষ্টা মাত্র। 

শুধু ধর্মের জিগির তুলে অথবা বিদেশি ষড়যন্ত্রের দোহাই দিয়ে অবস্থা সামলানো যাবে না। ইরান জেগে উঠেছে। সে জাগরণের সম্মুখসারিতে দেশের মেয়েরা। অবাক কী, ইরানের মেয়েরা এখন আকাশ ছোঁয়ার কথা ভাবছেন। এভারেস্ট বিজয়ের পর এটি তাঁদের আরেক শৃঙ্গ বিজয়।

৫ ডিসেম্বর ২০২২, নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক