মতামত

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কেন ‘বাহবা’ দিতে হয়

একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা ও গবেষণার মধ্য দিয়েই অবদান রাখবে না, তরুণ সমাজের মধ্যে নেতৃত্বগুণও তৈরি করবে। এখানে রাজনীতি, বাক্‌স্বাধীনতা ও নৈতিকতার চর্চাও হবে। দেশের ইতিহাসের নানা বাঁকে এসব কিছুর চর্চা আমরা দেখতে পাই।

স্বাধীনতার পর এখানে পরিণত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠারই স্বপ্ন বা সম্ভাবনা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু দিন যতই সামনে এগিয়েছে সেই সম্ভাবনায় ধরেছে ঘুণ পোকা।

একটা সময় এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য বা ভাইস চ্যান্সেলরদের নাম শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। সমাজের কাছে তাঁরা বিজ্ঞজন ও পণ্ডিত লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের নিয়ে সমালোচনা থাকলেও অসম্মান করার লোক কম ছিল। এমনকি জাঁদরেল উপাচার্যদের বিরুদ্ধে কথা বলাও যেত, সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগেরও নজির এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে।

এখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন কারা? গত দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে যে পরিমাণ ঠাট্টা-বিদ্রূপ-তামাশা আমরা দেখি, তাতেই বোঝা যায়, কারা বা কেমন শিক্ষককে এই মহান দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের পেশিশক্তি চর্চা, শিক্ষকদের ক্ষমতাচর্চা ও মেরুদণ্ডহীনতা এবং উপাচার্যদের একনায়কসুলভ আচরণ—এসবের কোলাজই এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা।

এ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিষ প্রবেশ করেছে, তার সবকিছুর নমুনাই এখানে পাওয়া সম্ভব। দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়, জুলুম, নাগরিক অধিকার ও বাক্‌স্বাধীনতার হরণ, বিচারহীনতা, ভিন্নমত দমন—এসব নিয়েই তো চলছে দেশ। এ সবকিছুই আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। সর্বশেষ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিককে যেভাবে বহিষ্কার করা হলো, তা নজিরবিহীনই বলা যায়।

সেই সাংবাদিক কী করেছিলেন? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাওয়া নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে সেটিই তো তাঁর দায়িত্ব ছিল।

গত ৩১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈন। সেখানে তিনি বলেন, ‘একজন আমাকে এসে বলছিল, স্যার এই দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নতি হচ্ছে না। আমি তাকে বললাম, উল্টোটা বলো না কেন? এই দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে।’

তিনি তখন উদাহরণ দিচ্ছেন এভাবে, ‘দুর্নীতির কারণে এখন সবার পকেটে টাকা, সবার মা–বাবা ঘুষ খায়। কিন্তু এই ঘুষ খায় বলে কী হয় জানো, এই ঘুষের টাকা আছে বলেই দৌড়ে যায় পদ্মার পাড়ে ইলিশ খেতে। পদ্মা পাড়ের গরিব মানুষেরা সেখানে দোকান দিয়েছে, যা বিক্রি করে তাদের পেটে ভাত জুটছে। ইকোনমিক মেশিনারিজ আর অল ফাংশনাল কারণ আমাদের কাছে পয়সা আছে। পয়সাটা আসছে কোথা থেকে? ঘুষ থেকে।’

তাঁর মতে, অর্থনীতিবিদেরা দুর্নীতি নিয়ে কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্য করেন না। তবে যাঁরা পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে থাকেন। নৈতিকতার জায়গায়ও এটি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে অর্থনীতির জায়গা থেকে দুর্নীতি কখনোই উন্নয়নের জন্য বাধা নয়।

তিনি এভাবে বলছেন, ‘ইকোনমিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেয়ারস লজিক’... ‘ইফ ইউ সে দ্যাট করাপশন অ্যাকচুয়ালি ব্লকস দ্য ডেভেলপমেন্ট, দ্যাটস নট ট্রু।’

উপাচার্য আবদুল মঈনের বক্তব্যে দুর্নীতির পক্ষে স্পষ্ট উৎসাহ আছে। দুর্নীতি উন্নয়নের জন্য বাধা নয়, সেটি তিনি কোথায় পেয়েছেন, আমরা জানি না। যে দুর্নীতির জন্য গোটা দেশ পঙ্গু হতে বসেছে, সেখানে কী করে এমন কথা তিনি বলেন? দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা তিনি দেখেন না, হাজার হাজার কোটি অর্থ পাচারের ঘটনা তিনি জানেন না? তিনি কি এতটাই অন্ধ যে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের দৌড় বা ওএমএসের চালের জন্য রাতভর মানুষের অপেক্ষা দেখেননি?

এই বক্তব্যের অডিও রেকর্ড এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। সেই বক্তব্য ধরেই সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার। যিনি ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির অর্থ সম্পাদকও।

উপাচার্য আবদুল মঈনের বক্তব্যে দুর্নীতির পক্ষে স্পষ্ট উৎসাহ আছে। দুর্নীতি উন্নয়নের জন্য বাধা নয়, কেন এমনটি তাঁর মনে হলো, তা আমাদের বুঝে আসে না। আমরা বরং দেখছি, দুর্নীতির জন্য গোটা দেশ পঙ্গু হতে বসেছে। দেশের ব্যাংকগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে, হাজার হাজার কোটি অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আইন করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অর্থ লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় তো তিনি না জানার কথা না।

তিনি কি টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের দৌড় বা ওএমএসের চালের জন্য রাতভর মানুষের অপেক্ষা দেখেননি? বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কীভাবে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে—এ নিয়ে তো কতবার পত্রিকার খবর হলো। এসবের পেছনে দুর্নীতি নেই—তা কী করে তিনি অস্বীকার করেন?

ইলিশ বিক্রি করে পদ্মাপাড়ের গরিব মানুষদের আসলে ভাত জুটছে কি? আমাদের মনে বরং প্রশ্ন জাগে, পদ্মাপাড়ের মানুষ ইলিশ বিক্রি করেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম গরিব জেলেই কেন থেকে যায়? ঘুষের টাকা নিয়ে কষ্ট করে কেউ এখন আর পদ্মাপাড়ে ইলিশ খেতে যায় না, সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে সহজেই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। সেই টাকায় গড়ে উঠছে কানাডার বেগমপাড়া, দুবাই ও সিঙ্গাপুরের স্বর্গরাজ্য। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এসব তো তাঁর না জানার কথা না।

প্রথম আলোর ২০২২ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘দুর্নীতি উন্নয়নের বড় বাধা’ শিরোনামে এক লেখায় বলেছেন, ‘দুর্নীতির ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় হয়, ধনিক ও প্রভাবশালীবান্ধব ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতিচর্চার বিকাশ হয়, আইনের শাসন ব্যাহত হয়, রাষ্ট্রকাঠামো ক্রমে দুর্বলতর হয় এবং শাসনব্যবস্থার ওপর জন-আস্থার সংকট ত্বরান্বিত হয়।’ তাহলে কী করে উপাচার্য আবদুল মঈন বলেন, দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে।

প্রয়াত ড. আকবর আলি খান করোনাকালে দৈনিক যুগান্তরকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হচ্ছে। পঙ্গুত্বের করাল গ্রাস থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতি রোধ করতে হবে। দুর্নীতি রোধ করতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। দেশের প্রায় সব খাতেই সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। সুশাসন না থাকলে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা হবে না।

এত সহজ ও বাস্তব কথাগুলো নিশ্চয়ই আবদুল মঈনের না বোঝার কথা নয়, কারণ তিনি একজন বিশ্ববিদ্যলয়শিক্ষক, এমনকি উপাচার্যও। এখন তাঁর এমন অযৌক্তিক বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকের ওপর যেভাবে ক্ষমতার জোর খাটানো হলো, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদিও উপাচার্য মহোদয় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অপসাংবাদিকতা। আমি তো উদাহরণ হিসেবে থিওরি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছি। সেখানে এভাবে তো বলিনি। আমার বক্তব্য খণ্ডিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।’

অন্যদিকে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী ইকবাল মনোয়ার বলেন, ‘আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। উপাচার্যের বক্তব্যের অডিও ও তথ্যপ্রমাণ আমার কাছে আছে। আমি ওনার বক্তব্য হুবহু লিখেছি। রাত আটটায় আমাকে রেজিস্ট্রার ভবনে ডাকা হয়। এরপর সই নিয়ে আমাকে অফিস আদেশ ধরিয়ে দেওয়া হয়। সাংবাদিকতার কারণে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।’

এটিই কি তাহলে উপাচার্যের ভাষায় একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের নিয়ম? অবশ্যই না। যার কারণে কুমিল্লার বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা ওই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়াকে ‘স্বৈরাচারী’ বলছেন। এটি শুধু একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারই না, স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চারও কণ্ঠরোধ।

এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিক সমিতি, ছাত্রসংগঠন, সাধারণ শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রতিবাদ উঠেছে। এরপরও যদি তাঁর বোধোদয় না হয়, ওই শিক্ষার্থী-সাংবাদিকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চার পথ সুগম না করেন, তাহলে বলতেই হয়, তাঁকে আমাদের ‘বাহবা’ দেওয়া উচিত; এমন একজন উপাচার্য আমরা পেয়েছিলাম, যিনি গোটা দেশের বর্তমান চিত্র কী সহজে প্রমাণ করে দিলেন।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী