তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ৪ নভেম্বর ইসরায়েল থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে নেন। যদিও এক মাসেরও কম সময় আগে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি শান্ত করতে কূটনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
কূটনৈতিক এই অবস্থান বদলের ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় যে, ইসরায়েল ও গাজায় সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তুরস্কের অবস্থান কীভাবে বদলে গেছে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামাসের হামলা ও ইসরায়েলিদের হত্যার পর খুব সতর্কভাবে ভারসাম্যমূলক বিবৃতি দিয়েছিলেন এরদোয়ান। সেখানে তিনি দুই পক্ষকে সংযম প্রদর্শন ও আগ্রাসী কর্মকাণ্ড না করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এরদোয়ান দ্রুত হামাসের পক্ষে এবং ইসরায়েল বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
২৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে এরদোয়ান ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেন, ‘এটি ইতিহাসের অন্যতম রক্তাক্ত ও সবচেয়ে বর্বরতম হামলা।’ হামাসকে তিনি ‘স্বাধীনতাপন্থী গোষ্ঠী’ বলেন।
তুরস্কের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি মনে করি, এরদোয়ান ঝাঁজালো বক্তব্য দিলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর সামনে যে বাধা আছে, সেটিকে মূল্যায়নে নেননি।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে এরদোয়ান বড় ধন্দে আছেন। দেশের ভেতরে তার রাজনৈতিক শক্তির যে উৎস, সেই দলগুলোকে তুষ্ট রাখতে হবে। এর বড় অংশটি ইসলামপন্থী এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি জোর সহানুভূতিশীল। আবার ইসরায়েলের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়াও এরদোয়ানের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ক সাম্প্রতিককালে আরও উষ্ণ হচ্ছে।
এ ছাড়া এরদোয়ান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একজন প্রধান খেলোয়াড় ও প্রভাবশালী মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে, সবকিছু একসঙ্গে কীভাবে করবেন এরদোয়ান?
হামাস-ফিলিস্তিন সংঘাতে এরদোয়ানের যে অবস্থান, সেটিকে তুরস্কের দেশজ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তববাদী রাজনীতি—এই দুইয়ের মাঝে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
গাজায় এবারের সহিংসতা শুরুর পর তুরস্কের জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের চাপে পড়েছেন এরদোয়ান। তাঁর প্রথম বিবৃতি তুরস্কের ইসলামপন্থীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। হামাসের প্রতি ইসলামপন্থী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সহানুভূতিশীল এবং হামাসের শীর্ষ নেতাদের অনেকের নিরাপদ আশ্রয় তুরস্ক।
তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদমেত দাভুতোগলু (এরদোয়ান অধীনে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন) ফিলিস্তিন ইস্যুতে এরদোয়ানের দ্বিধা ও সংশয়ের নিন্দা জানান। অন্যান্য ইসলামি দলও এরদোয়ান সরকারের প্রতি ইসরায়েলবিরোধী শক্ত অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। এর মধ্যে এরদোয়ান সরকারের জোটসঙ্গী ন্যাশনালিস্ট পার্টিও রয়েছে।
এরদোয়ান যদি হামাসকে প্রলুব্ধ করতে ইসরায়েলের প্রতি কড়া বাক্যবর্ষণ করে যান, তাহলে সবকিছু তার হাত থেকে দূরে সরে যেতে পারে। কিন্তু কথার বাইরেও নেপথ্যেও অনেক কিছু ঘটে। ইসরায়েলকে বাব্যবাণে বিদ্ধ করলেও এরদোয়ান তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক যাতে পুরোপুরি তিক্ত না হয়, তা ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
একটি বিষয় হলো, বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব বাড়ায় এরদোয়ান খোলাখুলিভাবে হামাসবিরোধী অবস্থান নিতে সাহসী হয়ে উঠেছেন। ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘তাৎক্ষণিক, স্থিতিশীল ও টেকসই মানবিক বিরতির’ প্রস্তাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর রাজধানীগুলোতেও বড় বড় বিক্ষোভ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের সরকারগুলোকে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন যাতে কমিয়ে দেয়, সেই দাবি করছেন।
এরদোয়ান এ ব্যাপারেও সচেতন যে সমালোচনার মাত্রা ছাড়ালে তেল আবিবের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়বে। তুরস্কের খুব গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইসরায়েল। দুই দেশই তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ইসরায়েলে তুরস্কের রপ্তানি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে যে গতিপথ বদল হচ্ছে, সে কারণে ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় হওয়ার শর্ত তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি আজারবাইজান-নাগার্নো কারবাখ সংঘাতের সময় আঙ্কারা ও তেল আবিবের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। দুই দেশই আজারবাইজান সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা করে ও অস্ত্র দেয়।
প্রথম থেকেই হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে এরদোয়ান একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে দেখতে চাইছেন। আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে হামাসের কাছ থেকে জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য আলাপ-আলোচনা করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে তুরস্কের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের।
ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও একই কৌশল নিয়েছেন এরদোয়ান। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এরদোয়ান প্রভাবশালী মধ্যস্থতাকারী হতে চান।
কিন্তু শান্তি স্থাপকের ভূমিকায় সফল হতে গেলে হামাস-ইসরায়েল দুই পক্ষের সঙ্গেই শক্তিশালী সম্পর্ক লাগবে এরদোয়ানের। তুরস্কের দিক থেকে মধ্যস্থতা করার প্রাথমিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস।
এরদোয়ান যদি হামাসকে প্রলুব্ধ করতে ইসরায়েলের প্রতি কড়া বাক্যবর্ষণ করে যান, তাহলে সবকিছু তার হাত থেকে দূরে সরে যেতে পারে। কিন্তু কথার বাইরেও নেপথ্যেও অনেক কিছু ঘটে। ইসরায়েলকে বাব্যবাণে বিদ্ধ করলেও এরদোয়ান তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক যাতে পুরোপুরি তিক্ত না হয়, তা ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
২৩ অক্টোবর ন্যাটোতে সুইডেনের যুক্ত হওয়ার প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন এরদোয়ান। এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক ও ন্যাটোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অচলাবস্থা অবসানের আশা তৈরি হয়েছে। একই দিন তুরস্কের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আঙ্কারা থেকে আইএসআইএসের ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। তুরস্কের গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে হামাসের নেতারা তুরস্ক ছেড়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আজারবাইজান থেকে তুরস্ক হয়ে ইসরায়েলে যে জ্বালানি তেল যায়, সেটির সরবরাহ বন্ধ করেনি তুরস্ক। জনমতের চাপ থাকার পরও তুরস্কে স্থাপিত বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। ৫ নভেম্বর তুরস্কের পুলিশ বিমানঘাঁটির বাইরে একটি জমায়েতও ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে।
এরদোয়ান দৃশ্যত তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভূরাজনীতি—এই দুই বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছেন। কিন্তু তার সাম্প্রতিক বিবৃতি বলছে, তিনি সরু দড়ির ওপর দিয়ে টলমলে পায়ে হাঁটছেন।
অজগার অসকান যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত