গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার ‘বিশ্বের ১ নম্বর দেশ’ হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু সেসবের প্রায় সবই দুর্নীতি বা দুর্যোগের জন্য। এবার ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট–এর বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে প্রোগ্রেস বা অগ্রগতির জন্য। কেন, কীভাবে? সেসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে আসুন আমরা একবার বুকভরে শ্বাস নিই এবং গর্বের সঙ্গে বলি, বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার পতনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিবর্তন, তা আসলে অগ্রগতি কি না, তা নিয়ে এখনো কোনো কোনো মহলে জিজ্ঞাসা রয়েছে। বিগত স্বৈরশাসনকালে যাঁরা সরাসরি অথবা অপ্রত্যক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন, তাঁদের জন্য শেখ হাসিনার পলায়ন মাথায় বাজ পড়ার মতো ঘটনা। তাঁরা যে এখনো এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছেন না, সেটাই স্বাভাবিক। ঢাকায় আমার এক অধ্যাপক বন্ধুকে ইকোনমিস্ট–এর রায়ের কথা জানাতে তিনি প্রায় তারস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘ওরা কি জানে, আমরা কেমন আছি?’
আমি নিউইয়র্কে দেখছি প্রতি সপ্তাহান্তে তাঁর মতো অনুগত সমর্থকদের নিয়মিত জমায়েত। গোপন আস্তানা থেকে শেখ হাসিনাও মাঝেমধ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন। তাঁর অনুগত সমর্থকদের কেউ কেউ ফেসবুকে এখনো গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে চলেছেন, আপা আসছেন বলে। তাঁদের কেউ কেউ হাসিনার স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসকে এতটাই বিবমিষার চোখে দেখেন যে তাঁকে ‘২০২৪ সালের ইয়াহিয়া’ নামে অভিহিত করে নিজেরাই নিজেদের অভিনন্দিত করেছেন।
এসব প্রতিক্রিয়া খুব সহজেই অনুমেয়। পরাজয় মেনে নেওয়া খুব সহজ নয়। তার চেয়েও কঠিন পরাজয়ের পেছনে যে ব্যর্থতা, তার দায়ভার স্বীকার করা। সাবেক সুবিধাভোগীদের অনেকেই যে বাংলাদেশকে ২০২৪ সালের সেরা দেশ বলে মানবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
যাঁরা এই পরিবর্তনকে সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছিলেন, তাঁদেরও কেউ কেউ খুব নিশ্চিত নন সেরা দেশ হওয়ার মতো যথেষ্ট অগ্রগতি, ইকোনমিস্ট–এর কথায় প্রোগ্রেস গত সাড়ে তিন মাসে বাংলাদেশে অর্জিত হয়েছে কি না। মধ্যরাতের তর্কবাজদের যেকোনো টক শো শুনলেই সে কথা টের পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় অভিযোগ বাজারে আগুন নিয়ে। এমনকি কথা বলার অধিকার নিয়েও সন্দেহ আছে। সাংবাদিকেরা নিজেরাই বলছেন, পুরোনো ভয় থেকে তাঁরা এখনো ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসব সীমাবদ্ধতার কথা ইকোনমিস্ট–এর অজানা নয়। তারা জোর দিয়েছে প্রকৃত অগ্রগতির চেয়ে অগ্রগতি অর্জনের সম্ভাবনার প্রতি। সেরা দেশ নির্বাচনের আগে পৃথিবীর পুরো রাজনৈতিক মানচিত্রটি তারা সামনে রেখেছিল, গত ১২ মাসে কোথায়, কোন দেশ প্রকৃত পরিবর্তনের পথে যাত্রা শুরু করেছে এবং এখনো হোঁচট খেয়ে পড়েনি, সেটি তারা হিসাবে নিয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়া ‘ফাইনালিস্ট’ হিসেবে যে দুটি দেশকে তারা বিবেচনায় রাখে, সেগুলো হলো সিরিয়া ও পোল্যান্ড। সিরিয়ায় বাংলাদেশের মতোই এক নাটকীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন অর্জিত হয়েছে, ৫৩ বছরের এক স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু এক আসাদকে সরিয়ে তারা প্রকৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে, সে দেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবে, সে কথা বলার মতো সময় এখনো আসেনি। বরং উল্টো, দেশটি গোত্র ও ধর্মের নামে তিন-চার টুকরা হয়ে যেতে পারে, এমন ভীতি বাড়ছে। এক সিরিয়ার বদলে চার সিরিয়ার উদ্ভব হতে পারে, যার প্রতিটি একে অপরের চেয়ে অধিক নিপীড়ক হিসেবে তকমা পেতে পারে।
অপর দেশ পোল্যান্ডের অবস্থা ভিন্ন, সেখানে যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা, তা কোনো বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, প্রথামাফিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপত্র মেনে এগোচ্ছে। ডোনাল্ড টাস্কের নেতৃত্বাধীন সিভিক কোয়ালিশন সরকার পূর্ববর্তী রক্ষণশীল ও কর্তৃত্ববাদী ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তসমূহ রদের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাংলাদেশ বা সিরিয়ার মতো নাটকীয় পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে বিপ্লব বলেছে। বিপ্লবের যে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, তা থেকে জানি, বিপ্লবোত্তর কোনো দেশেই রাতারাতি অবস্থা বদলায় না। শান্তি ফিরে আসে না। এর মুখ্য কারণ, পরাজিত ও অপসারিত শক্তি ক্ষমতার হাতবদল মেনে নেয় না, তারা ক্ষমতা ফিরে পেতে প্রতিবিপ্লবের তাজা বোমা তুলে নেয়।
সেরা দেশ নির্বাচনের আগে ইকোনমিস্ট–এর দক্ষিণ এশীয় সম্পাদক লিনা শিপার বাংলাদেশে এসেছিলেন। হাসিনার পতনের এক দিন আগে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। লক্ষ মানুষের মুক্তির আকুতি তিনি দেখেছেন, এটি যে দেশের মানুষের সম্মিলিত আশা ও দাবির প্রকাশ, এই বিষয়ে অন্ততপক্ষে তাঁর নিজের কোনো সন্দেহ নেই।
কর্মসূত্রে দেশটিতে তিনি আগে অনেকবার এসেছেন, মুখ ফুটে কথা বলতে ভীত মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। হাসিনার পতনের পর তিনি আবিষ্কার করলেন, দেশটির মানুষ আর ভীত নয়। মানুষ যখন একবার ভীতির বিরুদ্ধে জয়লাভ করে, বন্দুকের নল দেখিয়ে তাদের কাবু করা সহজ নয়। ইকোনমিস্ট–এর এক পডকাস্টে লিনা এই নতুন বাংলাদেশকে ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
প্রকৃত যে কারণে ২০২৪ সালের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করা হয়, তা স্বৈরশাসনের পতন নয়, সে পতনের পর যে সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে এবং বাংলাদেশ যেভাবে তার সদ্ব্যবহার করছে, তার জন্য।
ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে বিপ্লব বলেছে। বিপ্লবের যে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, তা থেকে জানি, বিপ্লবোত্তর কোনো দেশেই রাতারাতি অবস্থা বদলায় না। শান্তি ফিরে আসে না। এর মুখ্য কারণ, পরাজিত ও অপসারিত শক্তি ক্ষমতার হাতবদল মেনে নেয় না, তারা ক্ষমতা ফিরে পেতে প্রতিবিপ্লবের তাজা বোমা তুলে নেয়।
রুশ বিপ্লবের পর সে দেশটিকে ছয় বছর কাটাতে হয়েছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে। চীনা বিপ্লবের পর অশান্ত সময় গেছে আরও বেশি। প্রায় এক দশক পরও অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ও বহির্গত নাশকতার মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশের অবস্থা চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু এই দুই দেশের সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে, তা–ও অগ্রাহ্য করা যায় না।
ইকোনমিস্ট–এর ফরেন এডিটর প্যাট্রিক ফাওলস, যাঁর নেতৃত্বে সেরা দেশ নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়, এক পডকাস্টে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, কিন্তু আশার কথা, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশটি ইতিমধ্যেই স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে অগ্রগতি অর্জন করেছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতে পূর্বের অরাজকতা দূর হয়েছে। দেশটি সঠিক পথেই এগোচ্ছে।’
আমরা কতটা ধনী বা কী রকম সুখী, তা হিসাব করলে বাংলাদেশ হয়তো সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো না। ইকোনমিস্ট–এর বিবেচনায় সেসব সূচকের কোনোটাই অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বরং গণতন্ত্রায়ণ ও সুশাসনের পথে অগ্রসর হওয়ার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মানুষ নিয়েছে, সে কারণেই এই শিরোপা তাদের জুটেছে।
বাংলাদেশের মানুষ জয়লাভ করেছে এমন এক জগদ্দল, আপাত–অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যার অপসারণ ৫ আগস্টের কয়েক সপ্তাহ আগেও অসম্ভব মনে হয়েছিল।
অসম্ভবকে পরাস্ত করতে চাই সাহস, মৃত্যুকে অস্বীকার করার মতো অবদমিত মনোবল। এই সাহসী, অপরাজেয় বাংলাদেশকে যে সেরা দেশ নির্বাচিত করা হবে, তাতে বিস্ময়ের কী আছে!
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক