সম্প্রতি প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশি তরুণেরা এত বেশি দেশ ছাড়তে চায় কেন’ শিরোনামে আমার লেখাটি নিয়ে বেশ সাড়া পেয়েছি। পাঠক ও পরিচিত-অপরিচিত অনেকের কাছে নানা প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সে জায়গা থেকে নতুন লেখাটির অবতারণা করতে হলো। প্রশ্ন হলো, কেমন আছেন আমাদের দেশের তরুণেরা। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিকঠাক আছে তো?
২.
সাম্প্রতিক সময়ে কথা হলো তরুণশ্রেণির অনেকের সঙ্গে। এই আলাপটা করেছি কেবল তাঁদের ভেতরটা বোঝার জন্য। সবার কথার সুর যেন একসঙ্গে হতাশার গান হয়ে বাজল। অনেকেই খোলাখুলি বললেন, নানা কারণে হতাশ তাঁরা। পারিবারিক কারণ যেমন আছে, তেমনি সামাজিক কারণও আছে। চারদিকেই তো বিশৃঙ্খলার হাটবাজার।
আশা আসবে কোথা থেকে? তরুণেরা বললেন, তাঁদের সামনে এখন কোনো রোল মডেল নেই। যে শিক্ষকেরা একসময় শিক্ষার্থীদের কাছে পরম পূজনীয় ছিলেন, এখন বাটি চালান দিলেও এমন শিক্ষকদের খুঁজে পাওয়া কঠিন।
দেশ গড়ার বড় দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে। সেই রাজনীতিবিদদের কথা ও কাজের এত ফারাক, দিনের পর দিন তা দেখে তরুণেরা বিরক্ত ও হতাশ। একজন তরুণ বলছিলেন, কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার বচন বেশির ভাগ সময় হাস্যকর লাগে। প্রশ্ন আসে, কীভাবে তাঁরা এত দিন রাজনীতি করে এসেছেন। রাজনীতির ডিকশনারিতে মর্যাদা বলে কোনো শব্দ থাকবে না?
শুধু কি রাজনীতিবিদ? সমাজের বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা কি তরুণেরা পাচ্ছেন? বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীদের মত ও চিন্তা গোষ্ঠীবদ্ধতায় আটকে আছে। হক কথার মানুষ এই সমাজে কোথায়? অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে তরুণেরা হতাশ হবে না কেন?
আর যদি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা বলি, সেখানেও বন্ধ্যত্ব। এই সময়ে তেমন কোনো সাহিত্য আন্দোলন নেই, যার সঙ্গে আগ্রহী তরুণেরা একাত্ম হতে পারে।
এই ধারাবাহিক হতাশাই মেধাবী তরুণদের একটা অংশকে বিদেশমুখিনতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে যার যখন সুবিধা, যে যেভাবে পারছে, দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছে। এমনকি যারা দেশে ভালো চাকরি করছেন, তারাও সব বেচেকিনে ‘এ দেশের ভালো কিছু হবে না’ জপতে জপতে ইউরোপ-আমেরিকাগামী উড়োজাহাজে উঠে বসছেন। বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অবশ্যই ভালো, কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে দেশে না ফেরা মোটেই ভালো কথা নয়, যা ইদানীং দেখা যাচ্ছে। অথচ একসময় ছিল উল্টো। বিভিন্ন লেখায় পড়েছি অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ড ইত্যাদিতে পড়ে, এমনকি সেখান থেকে শিক্ষকতা ছেড়েও অনেকে দেশে ফিরেছেন। অনেকেই হয়েছেন বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, ব্যাংকের গভর্নর, মন্ত্রী, উপদেষ্টা।
তরুণদের মনের কথা লিখতে গেলে কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে। আর রাত হয়ে যাবে ভোর। এক তরুণ দম্পতি বলছিলেন, যাঁরা অতি সম্প্রতি ভারত ভ্রমণ করে এসেছেন, সে দেশে ভ্রমণ খরচের তুলনায় সেবা ভালো। আর আমাদের দেশে উল্টো। গলাকাটার বেলায় আছে, কিন্তু সেবা দেওয়ার বেলায় গড়িমসি। তাঁদের মতে, সার্বিক বিচারে আমাদের দেশে ভ্রমণ খরচ অনেক বেশি। এটা কেবল তাদের মত নয়, বোধ করি অনেকেরই মত।
৩.
সাম্প্রতিক সময়ে হতাশাগ্রস্ত তরুণেরা কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। খবরের কাগজ খুললেই এমন খবর। কতটা কষ্ট, ক্ষোভ আর হতাশা থেকে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেন! বেসরকারি একটি সংস্থা বলছে, ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
একজন শিক্ষার্থী যখন আত্মহত্যা করে, তখন সমাজের দেয়াল থেকে একটি ইট কি খসে পড়ে না? এখানে জবাবদিহির জায়গা কোথায়? খবরে পড়লাম রংপুরে এসআই নিয়োগের দৌড়ে অংশ নিয়ে এক চাকরিপ্রার্থী স্ট্রোকে মারা গেছেন। তিনি দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের পরিবার। বাবা কৃষক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। তবু চেয়েছিলেন পুলিশের চাকরি করতে, হয়তো একটু সচ্ছলতার জন্য। জীবনের কী নিদারুণ অপচয়!
৪.
তরুণদের মনের কথা লিখতে গেলে কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে। আর রাত হয়ে যাবে ভোর। এক তরুণ দম্পতি বলছিলেন, যাঁরা অতি সম্প্রতি ভারত ভ্রমণ করে এসেছেন, সে দেশে ভ্রমণ খরচের তুলনায় সেবা ভালো। আর আমাদের দেশে উল্টো। গলাকাটার বেলায় আছে, কিন্তু সেবা দেওয়ার বেলায় গড়িমসি। তাঁদের মতে, সার্বিক বিচারে আমাদের দেশে ভ্রমণ খরচ অনেক বেশি। এটা কেবল তাদের মত নয়, বোধ করি অনেকেরই মত।
ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে একটা ফিচার পড়ছিলাম। বেসরকারি চাকরিতে তরুণদের ছুটিছাটার সুযোগ নিয়েই লেখাটি। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কাগজপত্রে ছুটি কম নয়, কিন্তু কাটাতে গেলেই মুখ কালাকালি! একজন কর্মী যদি তাঁর অবর্তমানে তাঁর কাজটি কে করবেন এটা ঠিক করতে না পারেন, তাহলে ছুটি কাটানো খুবই কঠিন।
জিনিসপত্রের দাম নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। নবদম্পতিরা বেশি সংকটে আছেন বলে মনে হয়। নতুন সংসার, জিনিসপত্রের বাড়তি দাম, মাসের ৫ তারিখ বাসাভাড়া, সামাজিকতা, মফস্বলে থাকা বাবা-মা-ভাইবোন। অথচ মাইনে কম। বছর শেষে যা বাড়ে, মূল্যস্ফীতি তার চেয়েও বেশি। স্বামী-স্ত্রী একজনের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেই শেষ।
পরিণাম বিচ্ছেদ। এই শহরে প্রতি ৪০ মিনিটে একটি করে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে এবং তালাকের আবেদনের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে। প্রকৃতপক্ষে সমাজটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। যিনি বা যাঁরা নীতিনির্ধারকের চেয়ারে বসে আছেন, তিনি বা তারা কতটা তরুণ মনকে স্পর্শ করতে পারছেন সন্দেহ আছে।
বেকারত্বের কথা আর কি বলব। সাড়ে চার কোটি তরুণের বাংলাদেশে তরুণদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, এ তো চরম সত্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ।
করোনা মহামারির ধাক্কা, বিশ্বব্যাপী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অভিঘাত, রাজনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সংকট, দেশে দেশে জনতুষ্টিবাদীদের অব্যাহত বিজয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অত্যধিক তাপপ্রবাহ, বায়ুদূষণ, প্রচণ্ড মাত্রায় শব্দদূষণ, সড়কে বিশৃঙ্খলা, বিভীষিকাময় নগরজীবন—এ সবই তরুণ মনে হতাশার কারণ।
৫.
আমাদের তরুণদের মুখে মুখে এখন ‘ভাল্লাগে না’। যাঁদের বয়স ৩০ পেরিয়েছে, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ, অনেকের মধ্যেই আফসোস—কী করলাম জীবনে!
কিন্তু তরুণদের বোঝা দরকার, সবাই তো এক রকম মেধাবী হবে না। সবাই বিসিএস পাস করতে পারবে না। সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হবে না। ফোর্বসের উদীয়মান তরুণদের তালিকায় সবাই আসতে পারবে না। তাই বলে কি একটু কম মেধাবীদের আমরা ছুড়ে ফেলে দেব? যে তরুণের মধ্যে কর্তব্যবোধ আছে পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি, সেই-ই প্রকৃত তরুণ।
তাই পরিস্থিতি যতই বিরূপ হোক না কেন, তরুণদের এই ‘ভাল্লাগে না’ মনোভাব সবার আগে দূর করতে হবে। কোনো সুইচ টিপে দিলেই এটা দূর হয়ে যাবে না। এ জন্য দরকার সমাজে একটা সুস্থির পরিবেশ। আর আমাদের দেশে সব যে খারাপ হচ্ছে, তা তো নয়। সংগ্রাম করে বিজয় ছিনিয়ে আনার মধ্যেই তো প্রকৃত আনন্দ।
তবে তরুণ মনে হতাশা আছে, ভাল্লাগে না আছে, এটা আগে রাজনীতিবিদদের স্বীকার করতে হবে। সমাজে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা বেশি। কেবল তাঁদের ইতিবাচক ভূমিকায় সমাজে ধীরে ধীরে শৃঙ্খলা ফিরতে পারে। রাজনীতিবিদদের এমন ভূমিকা দেখার অপেক্ষায় এ দেশের তরুণেরা।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
alim.zaman@prothomalo.com