আমরা কি মিয়ানমারকে বুঝতে পারি

মিয়ানমার একটি খোলা বই যা বাঙালি খুব কমই পাঠ করেছে। বাংলাদেশে অল্প কিছু লোক মিয়ানমারের ইতিহাস জানেন।
ছবি : রয়টার্স

আমরা কি মিয়ানমারকে বুঝতে পারি? বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী মোটে দুটি। ইতিহাস আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেও বাংলাদেশের এই দুই নিকট প্রতিবেশীর (যথাক্রমে মিয়ানমার ও ভারত) সঙ্গে বাঙালির বড় ধরনের কোনো লড়াই বা অতি দীর্ঘ তিক্ত বিরোধের কোনো ঘটনা পাওয়া যাবে না। এর মানে অবশ্য এই নয়, কোনো বিরোধই নেই। আছে, তবে তা নিম্নমাত্রার, কিছুটা প্রচ্ছন্ন এবং তা সব সময় আমাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে না। রোহিঙ্গা সমস্যা একটি পুরোনো সমস্যা, যা বাংলাদেশকে স্পর্শ করে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা তখনই উঠেপড়ে লাগিনি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এমন প্রচ্ছন্ন বা ঢিলেঢালা তৎপরতা, যেকোনো পক্ষ অপর পক্ষের দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিতে পারে। দুটি প্রায় সমক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে একটি অতি সহিষ্ণু এবং ঢিলেঢালা আচরণ করলে, অপর রাষ্ট্রটি এই অবস্থাকে কীভাবে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায়—সেই চিন্তা করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক রাষ্ট্রই প্রতিপক্ষের দুর্বলতা থেকে নিজে লাভ করেছে। এতে যে সব সময় অন্য রাষ্ট্রটির উপকার হয়েছে, তা নয়। সব রাষ্ট্রই আগে নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। শুনতে কেমন লাগলেও এটাই হয়ে আসছে।

বাংলাদেশকে ঘিরে মিয়ানমারের তৎপরতা লক্ষ করলে বোঝা যায়, মিয়ানমার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এবং বাঙালির দুর্বলতাগুলো ভালোভাবেই জানে। বিশেষত, ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালে সীমান্ত ঘেঁষে তাদের গোলাগুলি এবং মর্টার সেল নিক্ষেপ—সবটাই এই জানা দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে আমি মনে করি। তারা জানে এবং তারা বেশ ভালোভাবে অনুমান করতে পারে, ঠিক কোন সময়ে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটালে আমরা কতটুকু বা কী প্রতিক্রিয়া দেখাব? অথবা কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাব না। একটি দৃষ্টান্ত দিই। ২০১৭ সালের অক্টোবরে হঠাৎ আরাকানে সামরিক অভিযান শুরু হয়।

লাখো নিপীড়িত রোহিঙ্গা জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশের সীমানার দিকে আসা শুরু করে। বাংলাদেশে আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ছিল, এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকার একদিকে আন্তর্জাতিক জনমত, অন্যদিকে মিয়ানমারের এসব নির্যাতিত মুসলমানের প্রতি দেশের মানুষের গভীর সহানুভূতির কথা স্মরণ করে মানবিক কারণে তাদের প্রায় সবাইকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়। আরেকটি বড় কারণ ছিল ২০১৮-এর নির্বাচন; সেখানে জনমত ধরে রাখারও ব্যাপার ছিল। সময়টা এমন ছিল যে বাংলাদেশ মানবিকতা দেখিয়েছে এবং নানা কারণে সে এটা করতে কিছুটা বাধ্যও হয়ে গিয়েছিল। মিয়ানমারের পরিকল্পনা এবং সময় নির্বাচন প্রায় নিখুঁত।

মিয়ানমার একটি খোলা বই যা বাঙালি খুব কমই পাঠ করেছে। বাংলাদেশে অল্প কিছু লোক মিয়ানমারের ইতিহাস জানেন। বামার ভাষা, এমনকি রাখাইনদের ভাষা লিখতে, পড়তে এবং বুঝতে পারেন—এমন কাউকে ঢাকায় পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই বর্মিজ স্টাডিজ পড়ানো হয় না। কোনো একটি দেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেলে—আগে তো সেই দেশটিকে আপনার বুঝতে এবং তার মনস্তত্ত্ব পড়তে, জানতে হবে।

আচরণের দিক থেকে সব সময় বন্ধুসুলভ নয় এমন প্রতিবেশী যদি আপনার দুর্বলতা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে তবে তা বিপজ্জনক। আরও বেশি বিপজ্জনক, যদি আপনি আপনার ওই প্রতিবেশী সম্পর্কে তেমন কিছু না জানেন বা নিদেনপক্ষে তার ভবিষ্যৎ-পরিকল্পনা কী হবে বা সে কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, সে সম্পর্কে আপনার কোনো স্বচ্ছ এবং যৌক্তিক অনুমান না থাকে। আমাদের রাষ্ট্র পর্যায়ে এমন কোনো অনুমান আছে কি না, আমি জানি না। শুধু জানি, মিয়ানমার এর পরে কী করতে যাচ্ছে, তা আমরা জানি না।

আর মাত্র বছরখানেক পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন আমাদের সীমানা ঘেঁষে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই, মর্টার হামলা এবং বাংলাদেশের ভেতরে হতাহতের ঘটনায় কূটচাল রয়েছে। আরাকানে রোহিঙ্গাদের জমিজমা পেলে যে শুধু সেনাবাহিনীর লাভ, তা নয়। এতে ওই এলাকায় ক্রমে উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠা আরাকান আর্মিরও লাভ আছে। আরাকান যার, ওই সব জমি তার। সেখানে চাষবাস, বিদেশি বিনিয়োগসহ বহু কিছুই করা যাবে। ফলে আমাদের সীমানায় এখন আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আর্মির লড়াই চলছে—এই পরিস্থিতির নানা দিক রয়েছে। একটি আশঙ্কা হচ্ছে, বিদ্রোহী আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দুই পক্ষ মিলেই তৃতীয় পক্ষ রোহিঙ্গা এবং চতুর্থ পক্ষ বাংলাদেশকে সম্ভবত অন্য কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। আমাদের জানা দরকার সেটা কী?

আরাকানে রোহিঙ্গাদের যে বিষয়সম্পত্তি আছে, এর অর্থমূল্য এবং রাজনৈতিক মূল্য অনেক। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার পর মিয়ানমার আরাকানে গ্রামের পর গ্রাম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে বলে একাধিক খবরে প্রকাশিত হয়েছে। এই তৎপরতা উদ্দেশ্যহীন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখনই বা আরও পাঁচ-সাত বছর পর রোহিঙ্গারা ফিরে গেলেও অনেকে তাদের বাড়িঘর আর খুঁজে পাবে না। রোহিঙ্গাদের সম্পদ দখল করা যেহেতু নানা পক্ষের একটা বড় স্বার্থ, তাই রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ যদি আর কখনো ফিরে না যায় তবে সবার স্বার্থই রক্ষা পাবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকানো এখন মিয়ানমারের একাধিক পক্ষের বড় লক্ষ্য। কাজটি বহুভাবে করা যায়। তবে শুরু করতে হবে সীমানার কাছাকাছি থেকে, যেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গা থাকে। এখনকার সংঘাত সীমানার পাড় ঘেঁষে হওয়ায় মিয়ানমারের অনেকগুলো লক্ষ্য অর্জিত হবে। প্রথমত, মিয়ানমার প্রথমে রোহিঙ্গাদের শোনাতে এবং বোঝাতে পারবে যে মিয়ানমারে এখন যুদ্ধ চলছে—ফিরে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একই উপসংহারে পৌঁছাবে। তৃতীয়ত, মিয়ানমার জানে যে যতই উসকানি দেওয়া হোক, কোভিডউত্তর বাংলাদেশ-স্থিতিশীল অর্থনীতি, বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি এবং পরবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন কোনো বড় ধরনের সংঘাতে জড়াবে না। অতএব সীমানার কাছে, একটা ভীতিকর যুদ্ধের মহড়া তারা বেশ কার্যকরভাবেই দেখাতে পারছে। চতুর্থত এবং সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার বাসনাটি নষ্ট করে দেওয়া।

এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে দৃশ্যত সব ঠিক থাকলেও যদি রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত না যেতে চায়, তাহলে তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না। এই বিধান ‘প্রিন্সিপাল অব নন-রিফুলম’ নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের সব রাষ্ট্রই মানতে বাধ্য, তা ১৯৫১ সালের শরণার্থী চুক্তিতে সই করুক বা না করুক। আরাকান অস্থিতিশীল থাকলে রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক।

আবার, যেসব রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত গ্রাম আছে, সেগুলোর দখল যদি কোনোভাবে আরাকান আর্মির কাছে চলে যায় বা তাদের দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রাখাইন-অধ্যুষিত আরাকান আর্মির দখলে থাকা ভূখণ্ডে কোনো রোহিঙ্গাই ফেরত যেতে চাইবে না। উল্লেখ্য, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যাদের সংঘাত বহু বছরের, এরা মূলত স্থানীয় রাখাইন। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা নিপীড়নে রাখাইনদের বিরাট ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

মিয়ানমার একটি খোলা বই যা বাঙালি খুব কমই পাঠ করেছে। বাংলাদেশে অল্প কিছু লোক মিয়ানমারের ইতিহাস জানেন। বামার ভাষা, এমনকি রাখাইনদের ভাষা লিখতে, পড়তে এবং বুঝতে পারেন—এমন কাউকে ঢাকায় পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই বর্মিজ স্টাডিজ পড়ানো হয় না। কোনো একটি দেশের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গেলে—আগে তো সেই দেশটিকে আপনার বুঝতে এবং তার মনস্তত্ত্ব পড়তে, জানতে হবে। আমরা কি সেই উদ্যোগ কখনো নিয়েছি? একাডেমিক চেষ্টা ছাড়া এ বিষয়ে ধারাবাহিক মানসম্মত কাজ বা পড়াশোনা চালানো কঠিন।

রোহিঙ্গা সমস্যার খুব ত্বরিত সমাধান হয়ে যাবে, এমন মনে হচ্ছে না। যদি সমস্যাটি আমাদের টানতেই হয়, তবে এর কার্যকর সমাধানের পথটি আসতে হবে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে, যাঁরা প্রতিনিয়ত মিয়ানমারকে পাঠ করবেন। আমাদের চেয়ে ভালো করে জানবেন। আমাদের চেয়ে ভালো বুঝবেন। এই কাজ শুধু একটি ডেস্কের কাজ নয়; অল্প কিছু মানুষের কাজও নয়; শুধুই সরকারের নয়। কিছু সমস্যায় জনগণকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সম্পৃক্ত করতে পারলে, তা সমাধানের পথকে প্রশস্ত করে, এটা বোঝা জরুরি। আমরা যত দ্রুত বুঝব, তত জট খুলতে থাকবে।

  • সাঈদ মাসুদ রেজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন।