গত ২৯ অক্টোবর প্রথম আলোর ৩-এর পাতার লিড ছবির শিরোনামের নাম ছিল ‘অপেক্ষা’। সহকর্মী আশরাফুল আলমের তোলা ছবি। একটি দেয়ালের দুই ধারে বিভিন্ন বয়সের অর্ধশতাধিক নারীকে অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে। দু-একজনের কোলে সন্তান, আবার কারও পাশে দাঁড়িয়ে শিশু। টিসিবির বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ সেই ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। দুপুর গড়িয়ে বেলা দুইটা বেজে গেলেও পণ্য পাননি অনেকে।
২৫ অক্টোবর প্রথম আলোর লিড শিরোনাম, পণ্যের চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম। নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতির কারণে খোলাবাজারে বাজার থেকে কম মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করছে খাদ্য অধিদপ্তর, টিসিবি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এসব বিক্রয়কেন্দ্রের পেছনে লম্বা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাহিদার তুলনায় পণ্যের জোগান কম। ফলে অনেককেই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ফেরত চলে যেতে হচ্ছে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানতম বয়ান ছিল উন্নয়ন। মাথাপিছু আয়, মেগা প্রকল্প আর প্রবৃদ্ধির জাঁকালো গল্পের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের জীবন আর জীবিকার সংগ্রাম। ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পুলিশ, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সম্পদ বেড়েছিল আলাদিনের চেরাগের মতো।
প্রতিবছর গড়ে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাওয়ায় ট্রিকল-ডাউন অর্থনীতির সূত্র অনুসারে, সম্পদের ছিটেফোঁটা চুইয়ে নিচের তলার মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি; বরং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাঁদের কর্মসংস্থানে বরাবরই সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই, সেই হকার, রিকশাচালক, ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতারা হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিক ও পুলিশি সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সম্পদ বানানোর হাতিয়ার।
অর্থনীতির এই লুম্পেনতন্ত্র বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী। এযাবৎ যারা ক্ষমতায় এসেছে, তা সে রাজনৈতিক কিংবা সামরিক কিংবা আধা রাজনৈতিক-আধা সামরিক, যে-ই হোক না; প্রতিটি সরকারই কমবেশি এই চর্চা করে গেছে। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনে সেটা ‘স্বর্ণশিখর’-এ পৌঁছেছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির টানাটানি ও সাধারণ মানুষের জীবনের দীর্ঘশ্বাসকে বোঝার জন্য বাজার থেকে কম মূল্যে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ডিম বিক্রি করা ট্রাকের পেছনের একেকটা লাইনই যথেষ্ট। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, শাসনক্ষমতায় যাঁরা যান, তাঁদের চোখ ক্রমেই এই লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো জীবনযাপনের সংকট থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ফলে এমন অনেক সিদ্ধান্ত আসে, যেটা জনতার পক্ষে না গিয়ে ক্ষমতার কাঠামোর এলিটদের পক্ষে চলে যায়।
শেষের শুরুটা করা যাক এক–এগারোর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ঘটনা দিয়ে। সরকার এসেই সড়ক, ফুটপাথ থেকে হকার ও নিম্ন আয়ের মানুষদের উচ্ছেদ শুরু করে। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছিল, তা একপর্যায়ে ছাত্র–জনতার বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল ছাত্রদের মর্যাদার লড়াইয়ের সঙ্গে এক জায়গায় এসে মিলে গিয়েছিল খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনের সংকট।
বিবিসি বাংলার খবর জানাচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম গত ৬ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাস্তা আর ফুটপাত আলাদা জিনিস। রাস্তায় দোকানপাট বসতে পারবে না।’
ঢাকার কোথাও কোথাও হকার কিংবা রাস্তা ও সড়কের পণ্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের খবর সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যৌথ বাহিনী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আবার সেই সড়ক ও ফুটপাতে বসে পড়ার খবরও জানা যাচ্ছে। এর কারণ আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়; বরং স্রেফ রুটিরুজির অসহায়ত্ব।
উচ্ছেদনির্ভর সমাধান যে প্রকৃতপক্ষে সমাধান নয়, সেই বোধ-সংবেদনা কোথাও কোথাও যেন অনুপস্থিত। বিশেষ করে গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে, রাষ্ট্রযন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলার ব্যবস্থা সেই আগের ধারায় চলছে। না হলে কেন বকেয়া বেতনের দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনে গুলি চলবে আর তাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্রমিক নিহত হবেন।
মিরপুরে ৭৮টি ব্যাটারিচালিত রিকশা জব্দ করে নিলামে তুলে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। বলতে পারেন, এই আচরণের মানে কী? আইন ভাঙলে জরিমানা করুন, জব্দ করে রিকশা বিক্রি করবেন কোন আইনে? প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, বাস অহরহ আইন ভাঙে। সেগুলো কি আপনারা জব্দ করে বিক্রি করে দেন?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ের জনতার আন্দোলন, শেষে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এ পর্যন্ত যে হতাহতের সংখ্যা, তার শ্রেণি বিশ্লেষণ করলে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। হকার, রিকশাচালক, ফুটপাতের ব্যবসায়ী। প্রথম আলো এই অভ্যুত্থানে শহিদদের যে তালিকা করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে করা একটা জরিপের বরাতে বলেছেন, ৮৫ শতাংশ আহতের কেউ কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পূর্ববঙ্গের এই ভূমিতে ইতিহাসে যতবার বাঁকবদল হয়েছে, ততবারই ছাত্রদের সঙ্গে জনতা যখন এসে দাঁড়ান, তখনই পরিবর্তনটা আসে।
নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে, এটা ভেবে তাঁরা যেমন রাস্তায় জনতার সঙ্গে মিলে যান, আবার শুধু ন্যায়-অন্যায়, ইনসাফ-বেইনসাফ ফয়সালার প্রশ্নে ন্যায়, সত্য ও ইনসাফের পক্ষে দাঁড়ান। ইতিহাসের গতিধারা নির্ধারণে তাঁরাই মূল শক্তি। অথচ এই ইতিহাসের উল্টো পিঠ হচ্ছে, যেই মাত্র তাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁদের বাদ দিয়ে দেওয়ার, তাঁদেরকে পর করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়ে যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত জন-আকাঙ্ক্ষা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলকতা। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি যে গুটিকয়েকের জমিদারি তালুক হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে মুক্ত করে সব নাগরিকের রাষ্ট্র ও সমাজে রূপান্তর করা। শাসকেরা এত দিন জনগণকে বিভক্ত করেই, তাঁদের মধ্যে বিভাজন জিইয়ে রেখেই শাসন ও শোষণ করে গেছেন। অথচ রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে গেলে জনতার ঐক্য জরুরি দাওয়ায়।
জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশকে বাইরে রেখে সেই ঐক্য গড়া সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের হিসাব বলছে, সাড়ে চার কোটি মানুষ চরম দরিদ্র্য। বছরের পর বছর ধরে তাঁরা অবমাননার জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখান থেকে তাঁরা মুক্তি চান। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের এটাই জন-আকাঙ্ক্ষা।
এটা সত্যি যে ঢাকার অনেক রাস্তা, ফুটপাত পথচারীদের হাঁটার আর কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এই যে একটা ঝুড়িতে কয়েক কেজি ড্রাগন, দুই কেজি আপেল নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে যাঁরা চাল, ডাল, নুন, আলু কিনে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছেন, কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারলে, ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করতে না পারলে এই সমস্যার কি কোনো টেকসই সমাধান আছে। সড়ক, ফুটপাতকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য অবশ্যই একটা সমন্বিত পরিকল্পনা থাকতে হবে।
ইউএনডিপির দারিদ্র্য সূচকে বিশ্বের ১১০ কোটি চরম গরিব মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ১৭ লাখ জন চরম গরিবি অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৬ শতাংশ মানুষের অবস্থা ভয়ংকর। দেশের ২৬ শতাংশ মানুষ যখন তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন, তখন এ ধরনের কোনো উচ্ছেদ আরও বহুসংখ্যক মানুষের পিঠকে দেয়ালে ঠেলে দেবে।
কেননা, পরিস্থিতি এমন যে কানের দুল বন্ধক রেখে টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছেন গোলতাজ বেগমের মতো মানুষেরা। হ্যাঁ, এ অবস্থা হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে যে অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসন চলেছে, তার ফলাফল এটি। কিন্তু আগের সরকারগুলোর যে আচরণ, তার থেকে একটা বিচ্ছেদ আমরা দেখব না কেন।
প্রান্তে সরতে সরতে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছিল বলেই শ্রমজীবী মানুষেরা ছাত্রদের আন্দোলনে মুক্তির পথ খুঁজেছিলেন। এই জন-আকাঙক্ষাকে বাদ দেওয়া যাবে না। রাতারাতি তাঁদের ভাগ্য বদল করা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যাতে তাঁদের জীবনের সংকট, দীর্ঘশ্বাস আরও বাড়ে। পেটে ভাতের টান পড়লে কিন্তু মানুষ রাস্তায় নামেন।
শেষের শুরুটা করা যাক এক–এগারোর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ঘটনা দিয়ে। সরকার এসেই সড়ক, ফুটপাথ থেকে হকার ও নিম্ন আয়ের মানুষদের উচ্ছেদ শুরু করে। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছিল, তা একপর্যায়ে ছাত্র–জনতার বিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল ছাত্রদের মর্যাদার লড়াইয়ের সঙ্গে এক জায়গায় এসে মিলে গিয়েছিল খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপনের সংকট।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী