মতামত

রাজনীতিতে সেতু, প্রত্যাশার বেলুন এবং ফুটবলের ভিশন

রাজনীতিতে প্রত্যাশার পারদ ওপরে তুলতে নেতাদের নানা কথাই বলতে হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিতও হয়। কিন্তু এর বিপজ্জনক বিপরীত দিকও আছে।
রাজনীতিতে প্রত্যাশার পারদ ওপরে তুলতে নেতাদের নানা কথাই বলতে হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিতও হয়। কিন্তু এর বিপজ্জনক বিপরীত দিকও আছে।

বাঙালি চরিত্র বড়ই রহস্যময়। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র আরও বেশি। তাঁরা কখন যে কি কথা বলেন, এর মর্মার্থ সব সময় বোঝা মুশকিল। কোনটা শুধু মুখের কথা, আর কোনটা বুকের ভেতরের কথা, বুঝতে মাঝেমধ্যেই ধন্দে পড়তে হয়। হালের রাজনীতির ‘চালিকা শক্তি’ টেলিভিশন টকশোওয়ালারা মুখের কথা নিয়েই ফেনা তুলতে ব্যস্ত। এর মধ্যেই দায়িত্বশীল নেতাদের কথায় কখনো কখনো আশাজাগানিয়া ইঙ্গিত প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দেয়।

১৬ নভেম্বর সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। কাজেই সেতু, সড়ক, সংযোগ, সেতুরক্ষা দেয়াল ইত্যাকার নানা বিষয় তাঁর দৈনন্দিন ভাবনা ও কাজের সঙ্গেই সম্পর্কিত। ধারণা করি, এসব বিষয় এখন তাঁর রাজনীতিক ভাবনার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। অন্তত ১৬ তারিখে তাঁর বক্তৃতা শুনে তাই মনে হয়েছে।

ওই বক্তৃতায় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও কাব্যিক ভাষায় তিনি বারবার রাজনীতিতে দেয়াল তোলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তা ভেঙে সেতু তৈরির কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, পঁচাত্তর থেকেই দেশে রাজনৈতিক দেয়াল তৈরি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা, ইনডেমনিটি জারি করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত করা, ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করা, জয় বাংলা স্লোগান বর্জন করা, জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে যেতে না দেওয়া, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, এর বিচার না করে নানা গল্প তৈরি করা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের মৃত্যুতে শোক জানাতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে বাসায় ঢুকতে না দিয়ে রাস্তায় বসিয়ে রাখা—এসবের মাধ্যমেই রাজনীতিতে দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলা ভাই সৃষ্টি, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান, তাদের মন্ত্রী বানানো, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যা, নির্যাতন, গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দুর্নীতিবাজদের দলীয় নেতৃত্বে রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেও রাজনীতিতে বিভেদের দেয়াল পোক্ত করা হয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘রাজনীতিতে এই বিভেদের দেয়াল আরও বড় করতেই থাকব, নাকি আমরা এই দেয়াল ভেঙে দুই পক্ষের মধ্যে সেতু তৈরি করব?’ তিনি সরল স্বীকারোক্তি করে বলেন, ‘আমাদের ভুল আছে, তারপরও আমরা দেশের জন্য কাজ করছি। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে; কিন্তু আমরা হত্যার রাজনীতি করি না।

বিএনপির সঙ্গে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছি না। দলের সম্মেলন সামনে রেখে কাজ করছি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র চর্চা করে।’ তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, ‘দেয়াল তোলার রাজনীতি থেকে সরে এসে আমাদের ব্রিজ (সেতু) তৈরির রাজনীতি শুরু করতে হবে।’

আমি নিশ্চিত, ওবায়দুল কাদের দেয়াল তৈরির কারণগুলোর যে তালিকা দিয়েছেন, দেয়ালের অপর পাশে যাঁরা আছেন, তাঁরাও এমন একটি তালিকা নিয়ে বসে আছেন। কাজেই এই সেতু তৈরির কাজ কে কখন কীভাবে শুরু করবেন, তার জবাব দেওয়া মুশকিল।

তবে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যটি আশাজাগানিয়া। এ থেকে অনেক বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। রাজনীতির মাঠে অনেক জাতের প্লেয়ার থাকে। আজকাল খেলার মাঠে যেমন আকর্ষণীয় সাজসজ্জার চিয়ার্স লিডার থাকে, তারা নিজেরা খেলে না, কিন্তু ‘গ্যালারি গরম’ রাখে, তেমনি আমাদের রাজনীতিতেও অনেক চিয়ার্স লিডার আছেন, যাঁরা রকমারি নামে মাঠে নেমে সত্যমিথ্যা আর উত্তেজনার তুবড়ি ছোটান, কিন্তু রাজনীতিটি করতে পারেন না, নিজের দলটি ঠিকমতো চালাতে পারে না।

ওবায়দুল কাদের চিয়ার্স লিডার নন, তিনি বড় একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল নেতা। তিনি যখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথের মধ্যে ব্রিজ তৈরির কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলেন, তখন সেই আহ্বানকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। জানি না, ওবায়দুল কাদেরের এপারের এই আহ্বান ওপারে পৌঁছাবে কি না। নদীতে সেতু তৈরি করতে হলে তো দুই পারেই প্রস্তুতি দরকার।

দুই পারের আগ্রহেই না সেতু তৈরি হয়। কারণ, সেতুতে লাভবান হয় দুই তীরই। আবার এই আহ্বানে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব শুধু রাজনীতিকদের একার নয়, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা ভাবেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে, তাঁদেরও দায়িত্বটি পালন করতে হবে।

সম্প্রতি দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির বড় সমাবেশগুলো নিয়ে এ রকম প্রত্যাশার বেলুনে গ্যাস ভরা হয়েছে। বিএনপি একটি বড় দল, তাদের বড় সমাবেশ করার ক্ষমতা আছে। এই সমাবেশ বন্ধ করার জন্য পরিবহন নিয়ে যে কর্মটি হয়েছে, তা খুবই নিন্দনীয়। কর্মীরা এরপরও যেভাবে সমাবেশ সফল করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাতেই হবে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এটাই তো পথ।

রাজনীতিতে প্রত্যাশার পারদ ওপরে তুলতে নেতাদের নানা কথাই বলতে হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিতও হয়। কিন্তু এর বিপজ্জনক বিপরীত দিকও আছে। তৈরি করা প্রত্যাশার কিছু অংশও যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে সেই প্রত্যাশার বেলুন ফুটো হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে পারে। এতে যে নেতা প্রত্যাশার বেলুন ফোলান, তিনি তো কর্মীদের কাছে হাস্যাস্পদই হন, দলকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন।

সম্প্রতি দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির বড় সমাবেশগুলো নিয়ে এ রকম প্রত্যাশার বেলুনে গ্যাস ভরা হয়েছে। বিএনপি একটি বড় দল, তাদের বড় সমাবেশ করার ক্ষমতা আছে। এই সমাবেশ বন্ধ করার জন্য পরিবহন নিয়ে যে কর্মটি হয়েছে, তা খুবই নিন্দনীয়। কর্মীরা এরপরও যেভাবে সমাবেশ সফল করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানাতেই হবে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এটাই তো পথ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকা, নানা নির্যাতন, নিপীড়নে ক্ষুব্ধ দলটি দেশের নানা সংকট তুলে ধরে এমন সমাবেশ করতেই পারে। কিন্তু একটু খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, কর্মীদের মরণপণ করে সমাবেশ সফল করার পেছনের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিএনপিরই কিছু নেতার বক্তৃতায় কিছু প্রত্যাশা তৈরি।

কী সেই বক্তব্য? বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। আরেক নেতা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে ‘আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো। এ সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন। আরেক নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেছেন, শিগগির তারেক রহমান দেশে আসবেন।

এই নেতারা কেউ বিএনপির চিয়ার্স লিডার নন, সবাই দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত। তাঁরা যে ঘোষণা দিয়েছেন, বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা–কর্মীদের কাছে এর চেয়ে প্রত্যাশার আর কিছু হতে পারে না। পরিবহন ধর্মঘট এড়িয়ে মাইলকে মাইল হেঁটে সমাবেশে যাওয়া তো ক্ষুদ্র বিষয়, এ প্রত্যাশা পূরণে তাঁদের অনেকে জীবন পর্যন্ত দিতে পারেন। দেখার বিষয় হচ্ছে, ১০ ডিসেম্বরের এই প্রত্যাশার গ্যাসে ভরা বেলুনটি কি আকাশে ওড়ে, নাকি ফুটো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়!

বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলছে। তাই ফুটবল নিয়ে তৈরি প্রত্যাশার আকাশছোঁয়া বেলুন এবং চুপসে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরেই শেষ করি।
২০১৩ সালের ১৩ জুন একটি খবর দেখতে পাচ্ছি। যেখানে বলা হচ্ছে, কাতারে বিশ্বকাপে খেলার লক্ষ্যের কথা প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ফুটবল ফেডারেশনের তখনকার (এখনো) সভাপতি সালাউদ্দিন। সে জন্য ‘ভিশন ২০২২’ নামে একটা উদ্যোগও নিয়েছেন তিনি।

বাফুফে ভবনে জাতীয় দলের ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ ও তার সহকারী রেনে কোস্টারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিপত্র তুলে দেওয়ার সময় বাফুফে সভাপতি বলেন, ‘২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে আমরা খেলবই। এর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তার জন্য আমরা প্রস্তুত। আজ থেকে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা মাঠে নামলাম। কাতারে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। আর সে জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং তা করতে আমরা প্রস্তুত।’

বাফুফের প্রশংসা করে ডি ক্রুইফ বলেন, ‘বাফুফের এই উদ্যোগ খুবই ভালো। আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। দুই পক্ষের মিলিত প্রচেষ্টায় সাফল্য পাওয়া সম্ভব। আমার বিশ্বাস, এটা অসম্ভব কিছু নয়। কাজটা অবশ্য সহজও নয়। তবে ফুটবলারদের প্রচেষ্টা, বাফুফে কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা এবং সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।’

২০১৩ থেকে ২০২২ সালে পৌঁছে গেছি আমরা। কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়েছে। জানতে ইচ্ছা করে, প্রত্যাশার বেলুন ফোলানো বাফুফে সভাপতি সালাহউদ্দিন কোথায়? বাংলাদেশের ফুটবলই কোথায়? ভিশন ২০২২–ই বা কোথায়? তবে চুপসে যাওয়া বেলুনটি যে পড়ে আছে সে তো দেখতেই পাচ্ছি!

  • মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক