মতামত

‘নৌকা দিছে, আবার ইলেকশন কিসের?’

পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মহারাজ।
ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন শতভাগ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে, তখন সেই দলেরই এক পাতি নেতা প্রতিপক্ষের প্রতি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন, ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিছে, আবার ইলেকশন কিসের?’

এই নেতার নাম মহিউদ্দিন মহারাজ। তিনি পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। আর ঘটনাটি কাউখালী উপজেলার শিয়ালকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন নিয়ে।

এই নির্বাচনে চারজন প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান গাজী, জাতীয় পার্টির (জেপি) নেতা ও ইউনিয়নের দু-দুইবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান সিকদার দেলোয়ার হোসেন, শিয়ালকাঠি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রহমাতুল্লাহ ও মহিউদ্দিন।

মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ১৮ জুন। আগের দিন ১৭জুন ঘটে অভূতপূর্ব এক ঘটনা। কাউখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিউদ্দিন মহারাজ জেপি প্রার্থী সিকদার দোলোয়ার হোসেনকে প্রার্থী না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হুঁশিয়ারি দেন।  

তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক বক্তা বলেছেন, আমরা কাউখালী থেকে সাইকেল (জেপির দলীয় প্রতীক) বিতাড়িত করতে চাই। শুধু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নয়, আগামী উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে আমরা সাইকেলকে বিতাড়িত করব। শেখ হাসিনা নৌকা দিছে। আবার ইলেকশন কিসের? আর ইলেকশন যদি হয়, বুঝিয়ে দেব ইলেকশন কাহাকে বলে।’ (প্রথম আলো, ২৬ জুন, ২০২৩)

দলীয় প্রার্থীকে নৌকা প্রতীক দেওয়ার অর্থ এই নয় যে সেখানে অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কিন্তু মহারাজের কথার ওপরে কে যাবেন? তাঁর এই হুমকি পাওয়ার পর দেলোয়ার হোসেন, রহমাতুল্লাহ ও মহিউদ্দিন মনোনয়ন ফরম জমা দেননি।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, ১৮ জুন মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান ছাড়া কেউ মনোনয়ন ফরম জমা দেননি।

কে এই মহিউদ্দিন মহারাজ? তিনি একসময় ছাত্রদল করতেন। এরপর জেপি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী থাকতে তাঁর এপিএস হিসেবে কাজ করেন। পরে মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদেরও এপিএস হন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ভবিষ্যতে এমপি হওয়ারও বাসনা রাখেন।

এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান সোহাগ হাওলাদার সিদ্দিকুর রহমানকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়ম রক্ষা করেছেন। দ্বিতীয় কোনো প্রার্থী না থাকায় ছিদ্দিকুর রহমানকে নির্বাচিত ঘোষণা করে দিয়েছেন। কিন্তু কী পরিস্থিতিতে সিদ্দিকুর রহমান একক প্রার্থী হলেন, কেন বাকি তিন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেও জমা দিলেন না, সেটা দেখা কি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়?

নির্বাচন কমিশনের কাজ তো কেবল তফসিল ঘোষণা করে মনোনয়নপত্র  বিতরণ ও গ্রহণ করা নয়। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে কি না, তা দেখাও তাদের দায়িত্ব। ২৭ জুনের আওয়ামী লীগের সভায় মহিউদ্দিন মহারাজের বক্তব্য কি নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়? সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। যদি নাও হয়ে থাকে মহরাজের বক্তব্যের অডিও ও ভিডিও আছে। সেটা পরখ করে দেখলেন না কেন তারা?  

একজন প্রার্থীর পক্ষে দলীয় নেতা বক্তৃতা দিতে পারেন। তাঁকে জয়ী করার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালাতে পারেন। তাই বলে নৌকা প্রার্থীর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে হুমকি দিতে পারেন না। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী যদি এতই জনপ্রিয় হন, তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ভয় পেলেন কেন? মহিউদ্দিন মহারাজও কেন বিনা ভোটে তাঁদের দলীয় প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে হুমকিঅস্ত্র ব্যবহার করলেন?  

বিএনপি জামায়াত নিয়ে তাদের অনেক ক্ষোভ ও অভিযোগ আছে। তারা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা হরদম বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নয়। কাউখালীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে যিনি লড়তে চেয়েছিলেন, তিনি জেপির নেতা। জেপি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। এর আগে সরকারেরও অংশীদার ছিলেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়, কাউখালীর ঘটনা তা প্রমাণ করে না। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও দায় এড়াতে পারে না। কাউখালীর রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে, দুই সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে অর্থের বিনিময়ে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এই অভিযোগ গুরুতর। প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে বসিয়ে দেওয়া কিংবা অর্থ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে রাখা দুটোই ফৌজদারি অপরাধ।

আমরা এই ইউপি নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হোক। আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মহারাজ যে প্রতিপক্ষকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, প্রার্থী হতে বারণ করেছেন, সেটা নির্বাচনী আচরণবিধির চরম লঙ্ঘন। এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা যায় না।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান, সেটা কি কাউখালী মডেলের? যদি না হয়, তাহলে তাঁদের উচিত হবে হুমকিদাতা নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া। একজন রাজনৈতিক নেতা কীভাবে বলেন, ‘শেখ হাসিনা নৌকা দিছে, আবার ইলেকশন কিসের?’

কে এই মহিউদ্দিন মহারাজ? তিনি একসময় ছাত্রদল করতেন। এরপর জেপি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী থাকতে তাঁর এপিএস হিসেবে কাজ করেন। পরে মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদেরও এপিএস হন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ভবিষ্যতে এমপি হওয়ারও বাসনা রাখেন।

যাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করেন না, তাঁদের দিয়েই কি আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।

  • ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com