কয়েক দিন আগে বিএনপির এক নেতা টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, তাঁদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে দেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা নিয়ে আসতে চাইছেন, সেটা লক্ষ করছি কি না। কী সেই ধারা, জানতে চাইলে তিনি বললেন, জাতীয় সরকার গঠন ও ৩১ দফার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা।
গত বছরের ১৩ জুলাই ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ ৩১ দফা ঘোষণা করে বিএনপি। এতে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো; ‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা প্রবর্তন; সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবে না; সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ চালুর কথা বলা হয়েছিল।
সে সময়েও বিএনপির পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু মিত্রদলগুলো খুব আমলে নেয়নি। তাদের কথা ছিল, আগে স্বৈরাচারী সরকার বিদায় নিক, এরপর সরকারের কাঠামো নিয়ে ভাবা যাবে, যদিও বিএনপি বা রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করেও শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারেনি। পরে আমরা দেখলাম, কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি জাতীয় সরকারের বিষয়টি আবার সামনে এনেছে। সম্প্রতি বিএনপির ঢাকা বিভাগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তারেক রহমান অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে ‘জাতীয় সরকারের’ মাধ্যমে দেশ পরিচালনা চায়। তাঁর দাবি, ‘স্বাধীনতার পর একটা জাতীয় সরকারের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসায় দেশ প্রথম দিন থেকেই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে একটা বিরাট অংশ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশ গঠনে কোনো অবদান রাখতে পারেনি।’ কিন্তু পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান এবং একানব্বইয়ে খালেদা জিয়ার শাসনামলে কি বিভক্তি বন্ধ হয়েছিল? হয়নি। ফলে সুযোগ একবার নয়, বারবার হাতছাড়া হয়েছে।
জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন, তার ইঙ্গিত দিয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণ নিশ্চয়ই সেসব দল বা ব্যক্তিকে জাতীয় সরকারে শামিল দেখতে চাইবেন না, যারা পুরো দেশকে একটা দল আর পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল। যারা তথাকথিত উন্নয়নের নামে আমাদের প্রত্যেকের কাঁধে দেড় লাখ টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে হাজার হাজার, লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। গুম-খুন, হামলা-মামলা নির্যাতনে দেশের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে।’
এর মাধ্যমে তারেক রহমান সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ বিএনপি বা তারেক রহমান প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা থাকছে না। কিন্তু এর বাইরে বাম–ডান–মধ্যপন্থী যেসব দল আছে, তাদের সবাই কি থাকছে?
বাংলাদেশে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদই প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন। আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি।
পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাসদ নেতা কর্নেল (অব.) আবু তাহের আওয়ামী–বাকশালী বাদে সব দলকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কাজে আসেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপির দুজন সংসদ সদস্যকে ভাগিয়ে এনে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করেছিল। কোনো দল বা পক্ষকে বাদ দিয়ে জাতীয় সরকারের কথা বললে সেটা জাতীয় থাকে না।
প্রশ্ন হলো, বিএনপির জাতীয় সরকার কতগুলো দলকে নিয়ে হবে? বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে, যারা বাংলাদেশি সমাজতন্ত্র কিংবা ইসলামী শাসনকাঠামোয় বিশ্বাসী তাঁরা কি বিএনপির সঙ্গে পঙ্ক্তিভুক্ত হতে চাইবে?
বিএনপি যখন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল বিরোধী জাতীয় সরকারের কথা বলছে, তখন বিএনপির প্রধান মিত্র জামায়াতের নেতাদের কণ্ঠে ভিন্ন সুর লক্ষ করা যাচ্ছে। জামায়াত তাদের পুরোনো মিত্র। ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে সরকারবিরোধী মোর্চা তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেই জোট থেকে বেরিয়ে এলেও জামায়ত, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির একাংশ সুখে–দুঃখে বিএনপির সঙ্গেই থেকে যায়। ২০০১–২০০৬ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারও গঠন করেছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। অন্যান্য ইসলামী দল নিয়ে জামায়াত আলাদা জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। অন্তর্বতী সরকারের সংস্কার নিয়েও দুই দলের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাক স্পষ্ট। বিএনপি চাইছে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। জামায়াত বলছে, সংস্কারকাজে যত সময় লাগে, তারা সরকারকে সময় দিতে প্রস্তুত।
ভারত ও আওয়ামী লীগ প্রশ্নেও তাদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিমিয় সভায় জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়া ও ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির নেতারা মনে করেন, যেই দল ১৫ বছর ধরে দমন–পীড়ন চালিয়েছে, তাদের ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে কেন?
ভারত নিয়ে জামায়াতের আমির বলেছেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগী দেশ আমাদের খুবই প্রয়োজন। প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আপনারা বদলানোর চিন্তা করেন কেন।’
এর প্রতিক্রিয়ায় তারেক রহমান বলেন, ‘গত কয়েক দিনে দেখেছি কিছু রাজনৈতিক দল একটি প্রতিবেশী দেশের ফাঁদে পা দিয়েছে। সে কারণে তারা বিভ্রান্ত ছড়ায়, এ রকম কিছু কথাবার্তা বলছে।’
দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা বিএনপির চেয়েও জামায়াতকে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। সে ক্ষেত্রে জামায়াত নেতার এই বক্তব্য নিয়েও সন্দেহ করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও নানা মত আছে। কেউ চাইছেন আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি দেশ চালাবে। আবার কেউ মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই গণতন্ত্রের পরীক্ষায় ফেল করেছে। ঢাকার রাস্তায় এমন স্লোগানও উৎকীর্ণ হয়েছে, নৌকা ও ধানের শীষ—একই সাপের দুই বিষ। ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ নিয়েও বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। নীল দলের বিপরীতে আগে তারা সাদা দলের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ ছিল। নীল দলের অনুপস্থিতিতে এখন তারা অনেকটা বিভক্ত।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াত ইসলামী বিএনপির সহযোগী না হয়ে অন্যান্য ইসলামী দলকে নিয়ে নিজেই ক্ষমতায় যেতে চাইছে। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবসম্মত? অতীতে মাঠের রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান যত শক্তিশালী হোক না কেন, ভোটের রাজনীতিতে তারা খুব সুবিধা করতে পারেনি। কোনো নির্বাচনে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। অন্যান্য ইসলামী দলের অবস্থা আরও শোচনীয়।
আবার জামায়াত বিএনপির জাতীয় সরকারের অংশীদার হলে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকেরা কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাও দেখার বিষয়।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি