হিরো আলম কি আসলেই হেরেছেন

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে ফল পাল্টানোর অভিযোগ তুলে হিরো আলম বলেছেন, ১০টি কেন্দ্রের ফল ছিনতাই করা হয়েছে।
ছবি: প্রথম আলো

ভোট মূলত বিনিয়োগ। অমুককে ভোট দিলে কী পাব, তমুককে ভোট দিলে কী পাব—এই বিচার করে ভোট দেওয়াই ভোটারের স্বভাবধর্ম। এ কথা হিরো আলম জানতেন এবং তাঁকে ভোট দিলে ভোটারের ভাগ্যে কী মিলবে, সে প্রশ্নের কোনো জোরালো উত্তর যে তাঁর কাছে নেই, তা-ও তিনি জানতেন। এ কারণে উপনির্বাচনে বগুড়া-৪ ও ৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারের সময় তিনি সরল-সোজা গলায় বলেছিলেন, তিনি যদি সংসদ সদস্য হন, তাহলে সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারবেন এক বছরের কম সময়। এ সময়ে আদতে তাঁর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। ফলে তাঁর কাছে ভোটারদের তেমন কিছু আশা করার নেই। তারপরও ভোটারদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে, তা গত কয়েক বছরে যেকোনো ভোটের সময় কোনো প্রার্থীর বেলায় দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না। অনেকেই বলছিলেন, ভোটাররা যদি ঠিকমতো ভোট দিতে পারেন, তাহলে হিরো আলম পাস করে যাবেন।

তবে শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, হিরো আলম দুটি আসনেই হেরেছেন। অস্তগামী সূর্যকে যেমন কেউ প্রণাম জানায় না, তেমনি ভোটে হেরে যাওয়া লোকের দিকে আগ্রহভরে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেওয়া হয় না। কিন্তু হিরো আলমের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটল। দেখা যাচ্ছে, হিরো আলমের যে প্রতিদ্বন্দ্বীরা জিতেছেন, তাঁদের নিয়ে সাধারণ লোকের বা সংবাদমাধ্যমের কোনো আগ্রহ নেই। অনেকে বিজয়ী প্রার্থীদের নামও জানেন না, জানার আগ্রহও তাঁদের নেই। তাঁদের সব আগ্রহ ‘হারু প্রার্থী’ হিরো আলমকে নিয়ে। প্রথম আলো তাদের প্রথম পাতায় হিরো আলমের ছবি দিয়ে শিরোনাম করেছে, ‘৮৩৪ ভোটে হার হিরো আলমের’।

হেরে যাওয়ার পরও হিরো আলমকে নিয়ে এত আগ্রহের প্রধান কারণ ভোট প্রক্রিয়া ও ফল ঘোষণার প্রতি মানুষের অনাস্থা ও অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাস হঠাৎই মানুষের মনে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। ক্রমাগত ভোট অনিয়মের বহুল চর্চায় ‘বুথ দখল’, ‘ভোট ডাকাতি’, ‘ভোট চুরি’, ‘রাতের ভোট’—ভোট-সংক্রান্ত এসব শব্দবন্ধ সবার মাথায় খুব যৌক্তিকভাবে ঢুকে গেছে। বিশেষ করে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের এই চর্চা যে ‘প্রকাশ্য-গোপন’ তা আর কাউকে বলতে হয় না। সেই প্রকাশ্য-গোপন ভোট রীতির চর্চা গতকালের (১ ফেব্রুয়ারি) ভোটেও দেখা গেছে।

গতকাল দুপুরে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে হিরো আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সদরের (বগুড়া-৬) কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাচে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ।’ তবে বগুড়া-৪ আসনের ভোট নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘কাহালু-নন্দীগ্রামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকচি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা খুবই ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামের নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উপনির্বাচনে সরাইলে আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোপন কক্ষে ভোটার ছাড়াও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি দেখা গেছে।

ভোট শেষ হওয়ার পর বগুড়া-৪ আসনের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে একের পর এক হিরো আলমের এগিয়ে থাকার খবর আসছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিরো আলমকে এমপি হিসেবে আগাম শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন অনেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এল, বগুড়া-৪ আসনে মহাজোটের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের কাছে ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন হিরো আলম। হিরো আলম অভিযোগ করলেন, ‘বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ফলাফলে এসে গন্ডগোল করেছে। নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে মশালের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।’

এ ধরনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এ দেশে প্রতিটি নির্বাচনেই পরাজিত প্রার্থীরা প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু হিরো আলমের যে অভিযোগটি সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তা হলো, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাঁদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে স্যার বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তাঁরা আমাকে মানতে চান না।’ অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই শিক্ষিত সমাজের আমলারা জানেন, তিনি পাস করলে তাঁকে তাঁরা সম্মান করতে বাধ্য হবেন এবং সেটি তাঁরা কিছুতেই মানতে পারেননি। সে কারণেই তাঁকে কারসাজি করে এমপির চেয়ারে বসতে দেওয়া হলো না।

হিরো আলমের এ অভিযোগকে কতজন লোক সত্য বলে মনে করেন, তা নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। কিন্তু এ পর্যন্ত যতজন লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের কেউই অভিযোগটিকে ফালতু বলে উড়িয়ে দেননি। অর্থাৎ পাবলিক পারসেপশন হলো, হিরো আলম একটি সুবিধাবঞ্চিত সমাজ থেকে উঠে আসার কারণে তাঁর প্রতি অবমাননা করা হলো। নির্বাচনী গণতন্ত্রে পাবলিক পারসেপশন বা জনধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রাহ্য বিষয়।

শিক্ষিত ও অভিজাত সমাজ থেকে উঠে আসা প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে জনগণ হিরো আলমের মতো একজন ‘অশিক্ষিত’ প্রার্থীকে কেন এত ভোট দিতে গেল; তাঁর মতো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন একজন অতি সাধারণ প্রার্থীকে ঠেকাতে কেন বুথে বুথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের লোকজনকে জোর-জবরদস্তি করতে দেখা গেল, সেই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, ভোটাররা এই প্রথাগত প্রার্থীদের ওপর চরম বিরক্ত। তাদের প্রতি ভোটারদের চার পয়সারও আস্থা নেই। এটি ঠিক, হিরো আলমের জনপ্রিয়তা ভোটারদের আকর্ষণ করেছে। কিন্তু তার বাইরে যে আসল সত্যটা লুকিয়ে আছে, সেটি হলো এই শিক্ষিত সমাজের পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় পরা সচ্ছল রাজনীতিকদের ‘ভোটাচরণে’ তাঁদের প্রতি জনগণের যে চরম বিরক্তি ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা উগরে দিতেই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন এবং হিরো আলমকে ভোট দিয়েছেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জন-আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। হিরো আলমের মতো তাঁদের একটি বিরাট অংশ বিশ্বাস করে, বগুড়া-৪ আসনে ভোট তুলনামূলক সুষ্ঠু হলেও ফল ঘোষণা সব উল্টে দিয়েছে। এই জনধারণা ভোট ব্যবস্থার প্রতি বিদ্যমান আস্থাহীনতাকে আরও তলানিতে নিয়ে যাবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি টক শোতে দেখলাম, একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা চরম অহমিকাভরে বলছিলেন, তিনি হিরো আলমকে নিয়ে একটি কথাও বলবেন না। কারণ হিসেবে তিনি রাখঢাক না করেই বললেন, ‘তাকে নিয়ে কথা বলতে আমার রুচিতে বাধে।’ কিন্তু এ পর্যন্ত ভোটে প্রকাশ্য অনিয়ম করে হিরো আলমের চেয়ে অতি ‘উচ্চ পর্যায়ের’ যে ‘শিক্ষিত’ ও ‘মার্জিত’ লোকেরা ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন এবং তারপর জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত কাবিখা থেকে শুরু করে তহবিল মেরে ফাঁকা করে দিয়েছেন (যার অকাট্য প্রমাণ সংবাদমাধ্যমে স্পষ্টভাবে এখনো রয়েছে), তাঁদের বিষয়ে কথা বলতে অবশ্য তাঁর রুচিতে বাধতে দেখা গেল না।

এই দেখে শেষ পর্যন্ত চরম হতাশ পাবলিক বলতে শুরু করেছে, হিরো আলম হারেননি। হেরেছে ইসি। হেরেছে নির্বাচনব্যবস্থা।

নোবেলজয়ী পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘সিইং’-এর গল্পে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাউকে ভোট না দেওয়ার মধ্যেও স্বীকৃতি লুকিয়ে থাকে

দুই.

নাম জানা নেই, এমন একটা দেশে ভোট চলছে। ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত। কিন্তু ভোর থেকে ভীষণ বৃষ্টি। ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে কেউ নেই। মনে হচ্ছিল ভোট আর হবে না। বেলা বাড়ার পর বৃষ্টি থামার পর হাজার হাজার ভোটার আসতে শুরু করলেন। ভোট গোনার পর দেখা গেল, ক্ষমতাসীন ডানপন্থী দল পেয়েছে ১৩ শতাংশ ভোট। মধ্যপন্থীরা পেয়েছে ৯ শতাংশ আর বামপন্থীরা পেয়েছে ২.৫ শতাংশ ভোট। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যালট ফাঁকা। এতে কোনো সিল মারা নেই।

এ ফল দিয়ে সরকার গঠন করা যায় না। ফলে সরকার আবার ভোট দিতে বাধ্য হলো। দেখা গেল, এবার ভোট আগের চেয়ে বেশি পড়েছে। আর এবারও ব্যালটে সিল পড়েনি। ৮৩ শতাংশ ব্যালট ফাঁকা। ভোটাররা কাউকে ভোট দেননি। ভোটাররা গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু সরকার এটিকে প্রতিবাদ হিসেবে দেখল না। সরকার মনে করল, একটি চক্র চক্রান্ত করে শুধু সরকারকেই ভেঙে দিতে চায় না, বরং তারা প্রচলিত ভোটনির্ভর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলতে চায়। সে কারণে সরকার এটিকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করল এবং প্রায় ৫০০ ভোটারকে ধরে আনল। দেশে কোনো মিছিল, বিক্ষোভ না থাকার পরও জরুরি অবস্থা দেওয়া ভালো দেখায় না বলে সরকার ও বিরোধী দল এক হয়ে দেশে ‘নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি’ সৃষ্টির চেষ্টা চালাল। সরকার ও প্রধান বিরোধী দল গোপনে একজোট হয়ে নিজেরাই সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ তৈরি করল। কিন্তু ভোটাররা সেই সন্ত্রাসীদের উসকানিতে পা দিয়ে তাদের ঠেকাতে রাস্তায় নামল না। তারা আগের মতোই চুপ থাকল। এ অবস্থায় সরকার আরও ক্ষেপে গেল। কাউকে ভোট না দিয়ে জনগণ সরকারকে ভেঙে দিতে চাইছে মনে করে সরকার ভোটদাতা জনগণকেই ভেঙে দিতে চাইল। এ লক্ষ্যে সরকার নতুন নতুন জনবিরোধী চক্রান্ত করতে লাগল।

বাংলাদেশের ভোট চুরি ও ভোট ডাকাতির গল্পের বিরতিহীন স্রোত জনগণকে সারামাগোর ‘সিইং’ উপন্যাসের অজানা দেশে নিয়ে ফেলবে কি না, জানি না। তবে প্রথাগত জাতীয় নেতাদের প্রত্যাখ্যান করতে ভবিষ্যতে যে আরও অনেক হিরো আলমকে এই ভোটাররা সামনে তুলে ধরবেন, তা নিশ্চিত জানি

এটি বাস্তবের কোনো দেশের কোনো সত্যিকার ঘটনা নয়। এটি নোবেলজয়ী পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘সিইং’-এর গল্পের প্লট। এ উপন্যাসে সারামাগো বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাউকে ভোট না দিলে, সেই না দেওয়ার মধ্যেও তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ একজনকে ভোট দেওয়া এবং আরেকজনকে ভোট না দেওয়ার মধ্যে প্রার্থী হিসেবে দুজনকেই স্বীকৃতি দেওয়ার দ্যোতনা নিহিত থাকে। কিন্তু যদি ভোটার কাউকেই ভোট না দেন, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় ভোটার প্রার্থী হিসেবে কারও অস্তিত্বকেই আর স্বীকার করছেন না। ব্যালটে সিল না দেওয়া নীরবতার মধ্য দিয়ে ভোটার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। আর ভোটার যখন ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রেই যান না, তখন তা ভোট বাক্সে খালি ব্যালট ফেলার চেয়েও বেশি তীব্র প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের ভোট চুরি ও ভোট ডাকাতির গল্পের বিরতিহীন স্রোত জনগণকে সারামাগোর ‘সিইং’ উপন্যাসের অজানা দেশে নিয়ে ফেলবে কি না, জানি না। তবে প্রথাগত জাতীয় নেতাদের প্রত্যাখ্যান করতে ভবিষ্যতে যে আরও অনেক হিরো আলমকে এই ভোটাররা সামনে তুলে ধরবেন, তা নিশ্চিত জানি।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com