মতামত

নৌকা যাঁর, নৌপথ তাঁর কবে হবে

একটি অটোরিকশার দাম যেখানে দুই লাখ টাকা, সেখানে নৌকার দাম দেড় লাখ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ, নৌপথের ইজারাব্যবস্থা।
ছবি: প্রথম আলো

ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে। বিশ্বখ্যাত ফরাসি পর্যটক ও চিকিৎসক। আওরঙ্গজেবের চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর ট্রাভেলস ইন মোগল এম্পায়ার (১৬৬৫-১৬৬৮) গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাংলায় দুইবারের ভ্রমণ থেকে আমি যে জ্ঞান অর্জন করেছি, তা আমাকে বলতে উৎসাহী করছে যে বাংলা মিসরের থেকেও সমৃদ্ধ।’

বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা গ্রন্থে স্যার উইলিয়াম উইলকক্স জানাচ্ছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে ১৮১৫ সাল নাগাদ মধ্য বাংলার জমিদার ও রায়তেরা খাল সংস্কার ও খাল ভরাট হওয়া পলি দিয়ে পাড় বাঁধানোর কাজে অবহেলা করেছিল। এই কাজকে বলা হয় ‘পুলবন্দী’।...বাংলায় এই গাফিলতির সূচনা হয় মারাঠা-আফগান যুদ্ধের সময়।

এ ছাড়া গোড়ার দিকে ব্রিটিশ বণিক ও নাবিকেরা সেচকাজ বিষয়ে কিছুই জানত না। যুদ্ধের পর এ রকম অজস্র জলপথ অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত থাকতে দেখে তারা ভেবেছিল, নদীগুলো কেবল জলপথের চলাচলের জন্য এবং তারাও এসবকে ফেলে রাখল।

এ অবহেলার জন্যই ১৬৬০ সালে বার্নিয়ের সময় বিরাজমান মধ্য বঙ্গের নদীগুলো ১৮১৫ নাগাদ পুরোনো গৌরব হারিয়ে ফেলল।...একবার সেই প্রাচীন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া গেলেই দেশটা যেন জাদুকরের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় জেগে উঠবে, আপনাদের সাবেক সমৃদ্ধি আবার আপনাদের দোরগোড়ায় উঁকি দেবে।’

বৈশ্বিক জিডিপিতে ইংল্যান্ডের অবদান যখন দশমিকের ঘরে, তখন বাংলার অবদান ছিল ৬ থেকে ৭ ভাগ। কীভাবে? প্রকৃতির অপার দান নদীমাতৃকার। হিমালয় ও নদ-নদী সবকিছু ঢেলে দিয়ে দেশটিকে গড়ে দিয়েছে। ব্রিটিশপূর্ব আমলে নবাবেরা, জমিদারেরা নদ-নদীর যত্ন করতেন। ব্রিটিশ প্রকৌশলী উইলকক্স নিজেই তা বলেছেন। কিন্তু বর্গি আক্রমণ ও পলাশীর যুদ্ধের পর নদ-নদীর রক্ষণাবেক্ষণে এক আনাও খরচ হয়নি, কোনো যত্ন হয়নি।

কিন্তু নবাবদের নামমাত্র জলকরকে ব্রিটিশরা নিলামে ওঠাল। ফলে সস্তার নৌপথ বিলাসে পরিণত হলো। সেই চক্র থেকে বের হওয়া গেল না। যেমন একই ব্রহ্মপুত্রে দুটি জায়গা। যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যয় নেই, নৌকায় পারাপার হয়, এমন একটি রুট চিলমারী-রৌমারী আর অন্যটি হলো রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থাপনা বঙ্গবন্ধু সেতু। ব্যয়বহুল বঙ্গবন্ধু সেতুতে যেখানে দুই যাত্রীসহ মোটরসাইকেলের টোল ৫০ টাকা, সেখানে চিলমারী-রৌমারী রুটে ২৪০ টাকা, আরও আছে ওঠানামার খরচ। চিলমারী-সুন্দরগঞ্জ হরিপুর খেয়া পার হতে হয় মূল তিস্তাসহ ছোট দুটি শাখা। মূল তিস্তার পাশাপাশি এ ছোট দুটি চ্যানেলেও টোল নেওয়া হচ্ছে।

একটি অটোরিকশার দাম যেখানে দুই লাখ টাকা, সেখানে নৌকার দাম দেড় লাখ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ, নৌপথের ইজারাব্যবস্থা। ইজারাব্যবস্থা না থাকলে নৌপথের ভাড়া সড়কপথের এক শ ভাগের এক ভাগে নেমে আসত। রাষ্ট্র যেন জনগণকে বেকায়দায় ফেলে আয় বাড়াতে চায়!

সড়কপথে চিলমারী থেকে কুড়িগ্রামের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার, ভাড়া ৪০ টাকা। আর নৌপথে চিলমারী থেকে রৌমারীর দূরত্ব ১২ কিলোমিটার, ভাড়া ১০০ টাকা। অন্যদিকে একটি অটোরিকশা বা ভটভটিতে ছয় থেকে আটজন যাত্রী পরিবহন করা যায়, সেখানে নৌকায় ১০০ থেকে ১৫০ জন।

একটি অটোরিকশার দাম যেখানে দুই লাখ টাকা, সেখানে নৌকার দাম দেড় লাখ টাকা। তবু এত ভাড়া কেন? কারণ, নৌপথের ইজারাব্যবস্থা। ইজারাব্যবস্থা না থাকলে নৌপথের ভাড়া সড়কপথের এক শ ভাগের এক ভাগে নেমে আসত। রাষ্ট্র যেন জনগণকে বেকায়দায় ফেলে আয় বাড়াতে চায়!

সাধারণত খেয়াঘাটের ইজারা পান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। আউলিয়া ঘাটের ইজারাদারও সরকারি দলের ওয়ার্ড কমিটির ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত আছেন মাড়েয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যানের ভাইয়েরা। প্রতিবছর যেহেতু আইনিভাবে ঘাটের ডাকের পরিমাণ বাড়ে, জনগণ সহ্য করে যায়। অথচ সড়কের মতো মুক্ত থাকলে মাঝিরা নিজেরা অটোরিকশা, সিএনজি বা বাসের মতো বন্দোবস্ত করে নিতেন।

সড়ক ইজারা না থাকলে নদী ইজারার যুক্তি কী? উল্টো ইজারার নিয়ন্ত্রণ থাকায় মাঝিরা আলাদাভাবে যাত্রী বহন করতে পারেন না। জেলা পরিষদের ইজারাদারির কারণে প্রাকৃতিক নদীপথে খরচ সড়কপথের চেয়ে বেশি। তা ছাড়া নৌকার প্রযুক্তি একেবারে স্থানীয় আর অটো, বাস হলো আমদানি করা। সড়কপথের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাত হলো তেল-মবিল আর যন্ত্র আমদানিনির্ভরতার পথ।

সম্প্রতি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার আউলিয়া ঘাটে মাত্র ৬০০ মিটার প্রস্থের করতোয়া নদীতে ৭১ জনের মর্মান্তিক নৌ দুর্ঘটনায় সলিলসমাধি সংঘটিত হলো। সেখানকার জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ সানিউল কাদের বলেন, ‘জেলা পরিষদ খেয়াঘাটের ইজারা দিলেও নৌযানের তদারকি ও যাত্রী পারাপারের বিষয় দেখে স্থানীয় প্রশাসন।’ একই অবস্থা সারা দেশেই।

নদীমাতৃক দেশে ঘাটে ঘাটে সেতুর দাবি জনপ্রিয় হয়—যে সেতু চর তৈরি করে, স্রোত বদলে দেয়, নদীকে ছোট করে আনে, নদ-নদীকে হত্যা করে। অথচ ইজারার প্রথা না থাকলে নদীপাড়ের মানুষেরা দেশি প্রযুক্তিতে নৌকা নিজেরাই বানিয়ে নেবেন। দরকার জাল যাঁর জলা তাঁরের মতো নৌকা যাঁর নৌপথ তঁার হওয়া।

 নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক

nahidknowledge@gmail.com