আর কত শিশুর ‘নাম নেওয়া’ বন্ধ করব!

বন্ধুদের সঙ্গে সড়কের পাশে খেলছিল প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ইয়াসিন (৭)। একটি ভটভটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দেয় তাকে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই প্রাণ যায় শিশুটির। ঘটনাটি গত বছরের জুন মাসের, ঘটনাস্থল বগুড়ার ধুনট উপজেলার তারাকান্দি গ্রাম।

ইয়াসিন ছিল মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ওই দুর্ঘটনার সময় বাবা আবদুল খালেক দেশের বাইরে ছিলেন। পরে দেশে ফিরে আসেন। এখনো তাঁর সামনে ছেলের নাম নেওয়া যায় না। কেন, নিলে কী হয়? ইয়াসিনের চাচা আবু তালেবের মুখে শুনুন সে কথা, ‘আমরা কেউ আর ছোলের কথা তুলি না। নাম শুনলেই ক্যাঁদতে ক্যাঁদতে অজ্ঞান হয়্যা যায়। ওই নাম লেওয়া যায় না।’

প্রথম আলোর শেষে পাতায় ২৭ জানুয়ারি ছাপা হওয়া ‘এক বছরে সড়কে নিহত ১১ শ শিশু’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এ প্রতিবেদনের শেষে সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি খবরের শিরোনাম ও পৃষ্ঠা নম্বর দেওয়া—‘“খেলতে খেলতে সড়কে প্রাণ গেল শিশুর”, পৃষ্ঠা ৪’। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এভাবে—‘অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলছিল শিশুটি। একপর্যায়ে সে বাড়ির পাশের সড়কে উঠে যায়। এ সময় একটি অটোরিকশা এসে তাকে ধাক্কা দেয়। এতে প্রাণ হারায় শিশুটি।’

ঘটনাটি ঘটেছে আগের দিন ২৬ জানুয়ারি, গাজীপুরের শ্রীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ি গ্রামের লিচুবাগান এলাকায়। নিহত শিশুটির নাম রোমান, বয়স মাত্র ২ বছর। বাবার নাম নাজিম উদ্দিন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদরের সুনতিয়ায়।

ইয়াসিনের চাচার কথা মনের ভেতর কাঁটা হয়ে ফুটছে, রোমানের কথাও কি তার মা-বাবার সামনে আর তোলা যাবে! যার যায়, সে–ই জানে কতটা গেল!

গণমাধ্যমে ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়, নামধাম যায়, পরিসংখ্যান জানা যায়; ইয়াসিন-রোমানদের মা-বাবার ভাঙা বুকের খতিয়ান কোথায় পাওয়া যাবে? কলিজার টুকরাকে হারিয়ে তাঁদের দিন কাটে কীভাবে, রাত পার করেন কোন ছটফটানিতে—কে রাখে খবর তার! অশ্রুপাত, তা–ও দেখা যায়, আশপাশে থাকা স্বজনেরা সান্ত্বনা দিতে পারেন, হাহাকারের আওয়াজ তবু শোনা যায়, পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখা যায়, কিন্তু সন্তানহারা মা-বাবার ভেতরের ভাঙনের শব্দ, রক্তক্ষরণ—কিসে তার উপশম; কে বলতে পারে তার উপায়—রাষ্ট্র, সরকার, আমি-আপনি? আমৃত্যু সন্তানশোক বয়ে বেড়ানোই কি আবদুল খালেক-নাজিম উদ্দিনদের নিয়তি?

ইয়াসিন-রোমানদের মতো না ফুটতেই ঝরে যাওয়া কত ফুলের সকরুণ গল্প লেখা হয় রোজ—বাংলাদেশের বুকে? ‘এক বছরে সড়কে নিহত ১১ শ শিশু’ শিরোনামেই এর উত্তর আছে, গড়ে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ যাচ্ছে তিনটি শিশুর। ২০২৩ সালের সড়ক দুর্ঘটনার এ হিসাব রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও নিজেদের সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হিসাবটি করা হয়েছে। এর বাইরে সড়কে আর কোনো শিশুর প্রাণ যায়নি, তাই–বা হলফ করে কে বলতে পারে?

যখন জানি, দেশের সড়কের অপর নাম ‘যেমন খুশি তেমন চলো’। দুই চাকা থেকে ছয়-আট চাকা, যান্ত্রিক থেকে অযান্ত্রিক—কোনো যান কি নিয়মের ধারেকাছে দিয়ে যায়? চালক থেকে সহকারী, গাড়ির মালিক থেকে যাত্রীসাধারণ, পথচারী পর্যন্ত—কেউ আইন মান্য করতে চায় কি না, আপনি-আমি শহর-গ্রাম যেখানেই বাস করি না কেন, ১০ মিনিট যেকোনো সড়কের পাশে দাঁড়ালেই এর উত্তর পাওয়ার কথা। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই কিছু আছে, তা এতটাই নগণ্য যে তা যেন মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে দেখার মতো।

শিশুরা ‘বাড়ির আঙিনা’য় খেলতে গিয়ে গাড়ির চাকায় পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারাবে? এ কোন অমানিশার কাল! বাড়ির আঙিনাই তো, ঘরের লাগোয়া সড়ক যে ‘মৃত্যুফাঁদ’, তা এই শিশুরা কোন জাদুবলে বুঝবে! প্রথম আলোর ২৮ জানুয়ারির ‘বাড়ির আঙিনায় পিকআপচাপায় শিক্ষিকার মৃত্যু’ শিরোনামই বলে দিচ্ছে, বাড়ির বেড়া, সীমানা ধরে যে ‘আঙিনা’র কথা বলবেন, সেখানেও আর নিরাপদ নয় কেউ! কক্সবাজারের রামুতে বাড়ির আঙিনায় ফুলগাছের পরিচর্যা করছিলেন স্কুলশিক্ষিকা ইমারী রাখাইন (৪৯)। এমন সময় একটি পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁকে চাপা দিয়ে প্রাণ কেড়ে নেয়।

সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষেরই (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, গত বছর প্রতিদিন সড়কে প্রায় ১৪ জনের প্রাণ গেছে। যদিও সরকারি এ হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যের পার্থক্য অনেকটাই।

মনে পড়ে, নিরাপদ সড়কের জন্য পাঁচ বছর আগে শিক্ষার্থীরা দেশ–কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন। তখন সরকারের তরফে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা কতটা ভিন্ন, তা আর কারও অজানা নয়।

ফি বছর মৃত্যুর পরিসংখ্যান, সড়কে অব্যবস্থাপনার চিত্র, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, পাস হওয়ার পরও আইন কার্যকর না হওয়ার আক্ষেপ। কত কমিটি, নানা সুপারিশ, গুচ্ছের সিদ্ধান্ত—কিছুই কি বাস্তবায়িত হয়?

শুধু কি স্বজন হারানোর অতল বেদনা, বুকভাঙা শোক? বিচার না পাওয়ার হতাশা, দোষীদের পার পেয়ে যাওয়াও কি ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যের দুঃখকে আরও বাড়িয়ে তোলে না? সন্তানহারা, স্বজনহারা মানুষগুলোর সামনে তাঁদের চলে যাওয়া প্রিয়জনের নাম না নেওয়াই কি তবে সমাধান!

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
    hello.hasanimam@gmail.com