এ দেশের সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় সচরাচর আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম তো নিয়ম নয়, তাই হিন্দুদের আওয়ামী লীগ সমর্থন নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় বটে, কিন্তু এই দল তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ দূরে থাক, নিরাপত্তাটুকুও নিশ্চিত করতে পারেনি। তবু কেন আওয়ামী লীগের প্রতি এই অন্ধ আনুগত্য? সে কথায় পরে আসছি।
সম্প্রতি রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে পূজা উদ্যাপন পরিষদের এক কর্মশালায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা প্রশ্ন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল সরকারে থাকার পরও দেশ কেন এত সাম্প্রদায়িক হলো? পাশাপাশি নেতারা ‘রাজনীতির দাবা খেলার ঘুঁটি’ হিসেবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যবহার না করারও আহ্বান জানিয়েছেন। হিন্দু নেতাদের বক্তব্য থেকে অনুধাবন করা যায়, তাঁরা একসময় বিশ্বাস করেছেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় থাকলে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ ঘটবে না। বলা বাহুল, তাঁদের সে বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। তাঁরা এখন আর ‘রাজনীতি-খেলা’র অংশ হতে চান না। তাহলে তাঁদের সামনে বিকল্প কী?
যাঁরা বলেন এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় চিরকালই আওয়ামী লীগের ‘ফিক্সড ডিপোজিট’, তাঁদের বক্তব্য অর্ধসত্য। কারণ, স্বাধীনতা–পূর্বকালে এ দেশের হিন্দু-সম্প্রদায়ের রাজনীতিসচেতন বড় একটি অংশ ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে শুধু নয়, অনেকে পার্টির জন্য পৈতৃক সহায়-সম্পত্তি পর্যন্ত দান করে গেছে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক মূলধারার রাজনীতিতে এ দুটি দলের ভূমিকা ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। স্বাধীনতা–উত্তরকালে জাসদের রাজনীতিতেও দলে দলে যোগ দিয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণেরা। কিন্তু জাসদের উত্থান-পতনের সঙ্গে তাঁদেরও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে পূজামণ্ডপে হামলা ও মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনায় এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রথম উপলব্ধি করেছিল, যে আদর্শ ও চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার অনেকটাই অধরা রয়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি মুছে গেলে সেই উপলব্ধি আরও গভীর হয়েছে।
১৯৯০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদে এক দল উগ্রবাদী হিন্দু হামলা চালালে তার খেসারত দিতে হয়েছিল এ দেশের নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়কে। অবশ্য ভারতের ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, এ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাঙচুর, বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। তখন এরশাদ সরকারের শেষ সময়। তিন জোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে পতনোন্মুখ স্বৈরাচারী সরকার তখন সাম্প্রদায়িকতার কার্ডটি খেলে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সরকারি দলের পরিকল্পনা ও উসকানিতেই যে বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ তখনকার পত্রপত্রিকা ওলটালেই পাওয়া যাবে। তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা এবং বিভিন্ন স্থানে যৌথভাবে সম্প্রীতি সমাবেশ ও মিছিল করেছিল।
সেই চরম দুর্দিনে সংখ্যালঘুদের কাছে এই বড় দুটি দলের প্রতিক্রিয়া ছিল ক্ষতস্থানে প্রলেপের মতো। মুক্তিযুদ্ধের পর আরও একবার এই আশা জেগেছিল যে দেশের প্রধান দুটি দলের যেকোনো একটি ক্ষমতায় গেলে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু এরশাদের পতনের পর বিএনপি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় আরও একবার হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য তখন বিএনপির সমালোচনা হলেও এই হামলা-নির্যাতনের ঘটনায় কেউ জোরালোভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ করেনি। বরং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ও সুযোগসন্ধানী লুটেরাদের দায়ী করে শাস্তি দাবি করেছিল দেশের সচেতন মানুষ।
কিন্তু বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের পর। সেবার জামায়াত-বিএনপি জোট বলতে গেলে বিজয় উদ্যাপনই করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মাধ্যমে। বাগেরহাট, ভোলা, সাতক্ষীরা, আগৈলঝাড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে, লুটপাট করে, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অজস্র ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন এক চেহারায় রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নিয়েছিল বিএনপি! যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন সেনানায়ক, যে দলটির নেতৃত্বে আছেন অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেই দলটির সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেখে সংখ্যালঘুরা স্তম্ভিত! দেশব্যাপী এই নৈরাজ্যের ঘটনায় তত্কালীন সরকার দোষীদের শনাক্ত করার, বিচারের আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ তো নেয়ইনি, উপরন্তু গুজব ও অপপ্রচার বলে এসব ঘটনাকে অস্বীকার করে এসেছে। তখন বোবা চোখে যেন রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে ছিল ধর্ষণের শিকার পূর্ণিমা শীল! বিএনপি তাদের শাসনামলের সেই দিনগুলোর জন্য ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা দূরে থাক, দুঃখ প্রকাশও করেনি কখনো। অবশ্য সম্প্রতি ৩২ দফা সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ নীতির ভিত্তিতে ক্ষমতায় গেলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।
শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলাম, আওয়ামী লীগের প্রতি সংখ্যালঘুদের অন্ধ আনুগত্য কেন?—এর নিতান্ত সরল উত্তর হতে পারে, ‘মন্দের ভালো’। আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো মনে করে সংখ্যালঘুরা। নানা বঞ্চনা সত্ত্বেও এই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা উপাচার্য থেকে পুলিশ কমিশনার, এমনকি প্রধান বিচারপতি (তাঁর বিতর্কিত বিদায় প্রসঙ্গটি আপাতত তোলা থাক) পর্যন্ত পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এ নিয়ে সমাজে গাত্রদাহও আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার প্রতিফলন দেখা যায়।। কিন্তু যাঁরা এর সমালোচনা করেন, তাঁরা এ কথা বলেন না, দেশে-বিদেশে যাঁদের কৃতিত্বের জন্য আমরা জাতি হিসেবে গৌরব বোধ করি, তাঁদের মধ্যেও তুলনামূলক হিসাবে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বরং বেশিই। যোগ্যদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সংখ্যা’র হিসাব থেকে বেরিয়ে তো আসতেই হবে। এসব দিক বিবেচনা করে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে রাখে সংখ্যালঘুরা। কিন্তু গত ১৪ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে কি শান্তি ও স্বস্তিতে ছিল সংখ্যালঘুরা?
এ প্রশ্নের উত্তরে নাসিরনগর, রামু, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জের ঘটনার মতো অজস্র ঘটনা ভিড় করে আসে আমাদের চোখের সামনে। কখনো পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রেখে এসে, কখনো ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে গুজব ছড়িয়ে অসংখ্য সংখ্যালঘুর জীবন বিপন্ন করা হয়েছে এই আওয়ামী লীগ আমলেই। এর মধ্যে কোনো কোনো ঘটনায় এমনকি এ দলের লোকজনের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুরা ভোটার হিসেবে, সমর্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বিপদের সময় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মী, উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত কাউকে পাশে পেয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর সহিংসতার বিচার করেনি বিএনপি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে হাইকোর্টে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তত্কালীন বিচারক সাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠিত হয়। কমিশনে ২৮ হাজার ঘটনার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছিল। যাচাই-বাছাই করে এর মধ্যে ৫ হাজার ঘটনার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল কমিশন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সাহারা খাতুন। তিনি কথা দিয়েছিলেন ব্যবস্থা নেবেন। তারপর মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনিও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি। সুতরাং আজ আওয়ামী লীগ যখন বিএনপিকে ২০০১-২০০৬ সালের সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনার জন্য দায়ী করে, তখন বিএনপি পাল্টা প্রশ্ন তোলে, ঘটনা সত্য হলে আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে এর বিচার করেনি কেন? বিতর্কে-কুতর্কে সময় পেরোয়। নতুন করে সংঘটিত সহিংসতা পুরোনোগুলোর কথা ভুলিয়ে দেয়।
এসব অভিজ্ঞতা থেকেই সম্ভবত এবার নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দর-কষাকষিতে যেতে চান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, ‘নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়মে পরিণত হয়েছে।...তাই কী দেবেন আর কী নেবেন, নির্বাচনের আগেই পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে নির্বাচনের মাঠে নামা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
সংখ্যালঘুদের ভোটকে ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ ভাবার দিন বোধ হয় শেষ হয়ে এল।
● বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
bishwabd@yahoo.com