সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের একটি ছবি ও ভিডিও চিত্র নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে বসে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খাবার খাচ্ছেন। টেবিলে নানা পদের খাবার সাজানো রয়েছে। ছবিটি নিয়ে নানা মত রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও এর সমর্থকেরা ছবিটি নিয়ে ইতিবাচক নিজেদের মতো করে বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই ছবি প্রচার করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ।
স্বাধীনতার পরপরই আওয়ামী লীগ মাওলানা ভাসানীর এমন একটি ছবি প্রচার করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের চেষ্টা করেছিল। সেই ছবিও ওই দিন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ছবির সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। সেবার মাওলানা ভাসানী খাবারের দাবিতে গণভবনের সামনে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ছবি নিয়ে নানা কীর্তি। রাজনীতিবিদ হায়দার আকবর খান রনোর ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ গ্রন্থের ৩১৭ নম্বর পাতায় এই ঘটনার উল্লেখ আছে।
এবার গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ডিবি অফিসে স্বেচ্ছায় যাননি। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর আগে তাঁকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে। আচ্ছামতো পেটানোর পর তাঁকে ধরে নিয়ে ডিবিপ্রধান কথিত আপ্যায়ন করেছেন। গয়েশ্বর রায়কে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কী এমন হলো যে রীতিমতো বারো পদ দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে? এ ঘটনা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর আলোচনা হয়েছে দিনভর। বিএনপির সমর্থক অনেকে মনে করছেন, পুলিশের খাবার গ্রহণ করা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ঠিক হয়নি; বরং তা প্রত্যাখ্যান উচিত ছিল।পরে অবশ্য সংবাদ সম্মেলন করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিস্তারিত নিজস্ব বক্তব্য দিয়েছেন।
তবে আমরা এই ঘটনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝতে পারি, তা হচ্ছে, পুলিশ গয়েশ্বর রায়কে ধরে নিলেও বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারেনি। এর পেছনে কোনো চাপ কাজ করেছে কিনা তা আমরা জানি না। তবে কিছুটা অনুমান করতে পারি। সম্ভবত মার্কিন ভিসা নীতি এ ক্ষেত্রে চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। আড়ালের ঘটনা যা হোক বা যে কারণেই হোক, পুলিশ যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ছেড়ে দেওয়া হবে, তখনই সম্ভবত এই দুপুরের খাবারের পরিকল্পনা করা হয় এবং খাবার গ্রহণের দৃশ্য ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা ‘রেজিম পুলিশিং’ বা শাসকগোষ্ঠীর পুলিশিং। এই ধরনের রেজিম পুলিশিং বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আমলে আমরা দেখেছি। বিশেষ করে গত শতকের ৬০ ও ৭০-এর দশকে মার্কিন প্রভাবিত লাতিন দেশগুলোতে রেজিম পুলিশিংয়ের প্রভাব দেখা যায়। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নঘেঁষা পূর্ব ইউরোপের দেশেও রেজিম পুলিশিং ছিল। ভিন্ন মতের দমন, পীড়ন, গুম, বিনা বিচারে হত্যা ওই সব দেশে তৎকালীন সময়ে নিত্যদিনের ঘটনা ছিল।
কিন্তু এই ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল কীভাবে? পুলিশের হেফাজতে থাকা কারও ছবি বা ভিডিও পুলিশ এভাবে ছড়িয়ে দিতে পারে কি না। আমরা ধরে নিতে পারি, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়েছে। পুলিশ ছাড়া অন্য কারও পক্ষে ওই সময় ওই কক্ষে খাওয়ার দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এটা সরাসরি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বরখেলাপ।
ওই দিন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা ‘রেজিম পুলিশিং’ বা শাসকগোষ্ঠীর পুলিশিং। এই ধরনের রেজিম পুলিশিং বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আমলে আমরা দেখেছি। বিশেষ করে গত শতকের ৬০ ও ৭০-এর দশকে মার্কিন প্রভাবিত লাতিন দেশগুলোতে রেজিম পুলিশিংয়ের প্রভাব দেখা যায়। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নঘেঁষা পূর্ব ইউরোপের দেশেও রেজিম পুলিশিং ছিল। ভিন্ন মতের দমন, পীড়ন, গুম, বিনা বিচারে হত্যা ওই সব দেশে তৎকালীন সময়ে নিত্যদিনের ঘটনা ছিল।
এর বাইরে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক, মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিবিয়া, হোসেন মোবারকের মিসর, রেজা শাহ পাহলভীর ইরানে ভয়ংকর রেজিম পুলিশিংয়ের কথা জানি। এই ধরনের পুলিশি ব্যবস্থা রাষ্ট্র বা জনগণের প্রতি অনুগত না থেকে শাসকের প্রতি বেশি অনুগত থাকে। শাসকের নির্দেশকে তারা অমোঘ বাণী বলে মনে করে। বিনিময়ে শাসকগোষ্ঠী পুলিশের অন্যায় অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়। ফলে পুলিশ বাহিনী শাসকের ইচ্ছেমতো চলে ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ক্ষেত্রে পেশাদারির কোনো বালাই থাকে না। আইনের শাসক না, শাসকের ইচ্ছাই সব ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে বিবেচিত হয়। এ ধরনের পুলিশে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন সবকিছুই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিশেষ দলের স্বার্থে হয়ে থাকে। জনসাধারণ কোনো সেবা পায় না; বরং রেজিম পুলিশিংয়ের ভয়ে তটস্থ থাকে।
অথচ পুলিশের পরিচালিত হওয়ার কথা জনবান্ধব বা ডেমোক্রেটিক পুলিশিং ব্যবস্থায়। এই গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থায় পুলিশ পরিচালিত হবে আইনের ভিত্তিতে। আইন আর কানুন দ্বারা নির্ধারিত হয় সবকিছু। জনগণকে সেবা দেওয়াই এই ধরনের পুলিশিংয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে এই পুলিশ কাজ করে না। জনসাধারণ, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুগপৎভাবে এই গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা কার্যকর থাকার কথা। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক পুলিশিং এ নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি হয়ে থাকে।
আমরা ইদানীং অনেকের মুখেই রাষ্ট্র মেরামতের কথা শুনি। বলা হয়ে থাকে, আমাদের রাষ্ট্রকে মেরামত করতে হবে। রাষ্ট্রকে যদি প্রকৃতপক্ষেই মেরামত করতে হয় বা মেরামতের প্রয়োজন হয়, তবে সবার আগে গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, রাষ্ট্র মেরামতে গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করবে। রাষ্ট্র মেরামতে এটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
গত শতকের ৮০ ও ৯০ দশকে লাতিন দেশগুলোতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সূচনা হয়। একই সঙ্গে পুলিশিং ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন ঘটে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শাসকদের হাত ধরেই লাতিনের দেশগুলো শাসকগোষ্ঠীর পুলিশিং বাতিল করে গণতান্ত্রিক পুলিশিং ব্যবস্থা গড়ে তুলে রাষ্ট্র পূর্ণ মেরামতে মনযোগ দিয়েছিল।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক