মতামত

সারা দুনিয়ায় কেন মার খাচ্ছেন সাংবাদিকেরা

ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গাজা সিটিতে তাঁর একটি ম্যুরাল আঁকা হয়েছে।
ছবি: এএফপি

বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মারাত্মক হারে সাংবাদিকেরা ভয়ভীতির শিকার হচ্ছেন এবং শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে অসংখ্য সাংবাদিককে হত্যা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে আজ সাংবাদিকেরা প্রতিদিন যেসব হুমকি মোকাবিলা করছেন, বিশ্ব গণমাধ্যম মুক্তি দিবস পালনের সময় সেসব হুমকিকে যথার্থ গুরুত্ব দেওয়ার সময় হয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, এমন একটি বিশ্ব আমাদের আছে, এটি নিশ্চিত করার জন্যও অনেক কাজ করতে হবে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ওই বছর কমপক্ষে ৬৭ জন সংবাদকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন। সংখ্যাটি ২০২১ সালের সংখ্যার চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।

সন্দেহ নেই, ইউক্রেন যুদ্ধ গত বছরের সাংবাদিক নিহত হওয়ার সংখ্যা বাড়ানোর পেছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে; কিন্তু হাইতি ও মেক্সিকোর মতো অনেক দেশে পুলিশি নির্যাতন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েও আমাদের অনেক সহকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।


ইসরায়েল ও দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় সেখানেও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে।
ইসরায়েলের দখল করে নেওয়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরের জেনিন শহরের একটি ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরে ২০২২ সালের মে মাসে ইসরায়েলি সেনারা ধরপাকড় অভিযান চালাচ্ছিলেন।

আমেরিকান-ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ্ ওই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করার সময় ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন।

সিপিজের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে রেকর্ডসংখ্যক সাংবাদিক কারাবন্দী হয়েছেন, যা বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দুর্বল হয়ে পড়ার আভাস দেয়।
সিপিজের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের ৩০টি দেশে কমপক্ষে ৩৬৩ জন সাংবাদিক আটক হয়েছেন এবং সাংবাদিক আটকের দিক থেকে শীর্ষে আছে ইরান, চীন ও মিয়ানমার।

সাংবাদিক আটকের সামগ্রিক সংখ্যা ২০১৫ সাল থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এবং তিন দশক আগে প্রেস ফ্রিডম গ্রুপ হিসাব রাখা শুরু করার পর থেকে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিবেদক ইভান গেরশকোভিচকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ‘চরবৃত্তি’ করার অভিযোগে মস্কো থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চীনের প্রথম সারির সাংবাদিক দং ইউয়ুকে একই অভিযোগে আটক করা হয়েছে এবং শিগগিরই তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিবেদক ইভান গেরশকোভিচকে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ‘চরবৃত্তি’ করার অভিযোগে মস্কো থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে

এই দুটি গ্রেপ্তারের ঘটনা আদতে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এখানে দুটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের দ্বারা সাংবাদিকতার ওপর একই কায়দায় দমন করতে দেখা যাচ্ছে, যার অভিপ্রায়ও অভিন্ন। সেই অভিপ্রায় হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা।


চীনা সাংবাদিক ইউয়ু রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গুয়াংমিং ডেইলির সম্পাদক ও সংবাদ বিশ্লেষক। তিনি ২০১৭ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একজন নিম্যান ফেলো হিসেবে যখন কাজ করছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। চীন যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে, সে বিষয়ে নিখুঁত ধারাভাষ্য ও বিশ্লেষণের জন্য ইউয়ু সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তাঁকে বছর খানেক আগে গ্রেপ্তার করা হলেও সে খবর তাঁর পরিবার প্রকাশ করেনি। শেষমেশ তাঁকে যখন বিচারের কাঠগড়ায় নেওয়া হচ্ছে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর কমপক্ষে ১০ বছরের জেল হবে বলে টের পাওয়া যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে এসে তাঁর পরিবার সে খবর প্রকাশ করেছে।

অন্যদিকে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর সাংবাদিক হিসেবে রাশিয়ায় বসে কাজ করা ৩১ বছর বয়সী গেরশকোভিচকে গত মার্চ মাসে ইয়েকাতেরিনবুর্গ থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে গ্রেপ্তার করা হয়।

সাংবাদিকদের আইনবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার ও আটক হওয়া এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার বাইরে সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত তাঁদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশি।

শীতল যুদ্ধের পর গেরশকোভিচই প্রথম কোনো আমেরিকান সাংবাদিক, যাঁকে রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার করল। রাশিয়া তাঁর বিরুদ্ধে চরবৃত্তির অভিযোগ আনলেও ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, হোয়াইট হাউস ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় থাকা গ্রুপগুলো সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অবিলম্বে তাঁকে ছেড়ে দিতে বলেছে।

সাংবাদিকদের আইনবহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার ও আটক হওয়া এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার বাইরে সারা বিশ্বে প্রতিনিয়ত তাঁদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশি।

পাকিস্তানের ঘরিদা ফারুকীর মতো বহু নারী সাংবাদিক জঘন্যভাবে চরিত্রহনের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার নারী সাংবাদিক মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়, জনপরিসরে যোগদানের সময়, ব্রেকিং নিউজ কভার করার সময় অপমান ও আক্রমণের শিকার হন। ঘরিদা ফারুকীকে নিশানা করে অনলাইনে আক্রমণ তার বড় উদাহরণ।

ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্ট (আইসিএফজে) ও ইউনেসকো যৌথভাবে প্রায় ৭০০ নারী সাংবাদিকের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছে। ওই নারী সাংবাদিকের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন বলেছেন, তাঁরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন।

উত্তরদাতাদের প্রায় ৩০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সেলফ সেন্সর’ করছেন। ৩৮ শতাংশ নারী সাংবাদিক অনলাইনে নিজেদের কম দৃশ্যমান করার চেষ্টা করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা আন্তর্জাতিকভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে গুরুতর সমসাময়িক হুমকিগুলোর একটি।’

গ্রাউন্ডট্রুথ প্রজেক্ট আমাদের এই সহকর্মীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে—সিপিজে, নিম্যান ফাউন্ডেশনসহ বহু সংস্থার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সাংবাদিক হত্যার বিচার চাচ্ছে। একই সঙ্গে বেআইনিভাবে সাংবাদিকদের আটক করা ও অনলাইনে অপমান অপদস্থ করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

গ্রাউন্ডট্রুথ অনেক সংবাদ সংস্থার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে গেরশকোভিচ ও ইউয়ু উভয়কে অবিলম্বে মুক্তি দিতে আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমার, ইরান, মিসর, নিকারাগুয়াসহ বিভিন্ন দেশে অন্যায়ভাবে আটক সাংবাদিকদেরও মুক্তি চেয়েছে।

  • আল-জাজিরা থেকে নেওয়া; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    চার্লস এম সেনোট গণমাধ্যম-সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা দ্য গ্রাউন্ডট্রুথ প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক