মতামত

এখনো প্রতিরোধ ও এখনো বদলা নেওয়ার রাজনীতি

বিএনপি ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচির দিনই ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ নিয়ে রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে
ছবি : প্রথম আলো

বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের একটি চিত্র প্রায় অভিন্ন। সরকারি দলের নেতা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কথা বলবেন। আর বিরোধী দলের নেতা সরকারের বিরুদ্ধে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।  বিজয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, একাত্তরের পরাজিত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাঁর ভাষায়,‘বিএনপি এদের উসকানি দিচ্ছে। ষড়যন্ত্র করছে।’

অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত। অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশ থেকে বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে আমাদের সম্পদ। সরকারের বিরুদ্ধে দমন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছেন তিনি।

দুই নেতাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভর করে কথা বলেছেন। কিন্তু চেতনাটি কি খোলাসা করেনি। অতীতে নিজেদের কর্মকাণ্ড দিয়েও তাঁরা তা পরিষ্কার করতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল সাম্য। এখন সমাজের সর্বস্তরে গুরুতর বৈষম্য বিরাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও সেটি অধরাই থেকে গেছে। নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় যান এবং ক্ষমতায় গিয়ে প্রথম যে কাজটি করেন, সেটি হলো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা। তাঁরা প্রশ্ন শুনতে অভ্যস্ত নন। প্রশ্ন না করার পরিবেশ তৈরি করতে সদা সচেষ্ট থাকেন।

বাংলাদেশের শাসনপর্ব ভাগ করলে দেখব, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের শাসনকা্ল ছিল পৌনে চার বছরের। দুই সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ দেশ শাসন করেছেন যথাক্রমে ছয় বছর ও পৌনে নয় বছর। এরপর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দুই দফায় দেশ শাসন করেছে ১০ বছর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯ বছর। এর বাইরে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ও তিনটি নির্দলীয় সরকার তিন মাস করে।

বিএনপি ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচির দিনই ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। সা্রা দেশ থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আসবেন। দলীয় সভানেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বলে পুরো শহরেই থাকবে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে বিএনপি গণমিছিল করতে চাইলে শহরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও যদি দেশে গণতন্ত্র না এসে থাকে কিংবা সাম্প্রদায়িকতার অবসান না হয়ে থাকে, তার দায়ও সবাইকে  নিতে হবে। জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও কেন সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করল না? দলটির নেতারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। আবার তাদের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে ধর্মভিত্তিক দলকেও সঙ্গী করতে দ্বিধা করে না।  অতীতে যাঁরা দেশ শাসন করছেন এবং বর্তমানে যাঁরা শাসন করছেন, সবাই নিজ নিজ স্বার্থে ধর্মকে ও ধর্মীয় দলকে ব্যবহার করছেন। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। কিন্তু অষ্টম সংশোধনী রেখে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যেদিন মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সংহত করার অঙ্গীকার করলেন, সেদিনের পত্রিকার দুটি খবর আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একটি মাগুরার। অপরটি ফেনীর।  মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘আমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলতে চাই, মাগুরার যাঁদেরকে  ১০ ডিসেম্বরের ওই সমাবেশ বা ওই পুরান ঢাকার সমাবেশে দেখা গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নেব। এই মাগুরায় আমরা কোনো সন্ত্রাসী, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে এক ইঞ্চি জায়গা দেব না।’

এই হুঁশিয়ারি যদি তিনি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে করে দিতেন, তাহলে কিছু বলার থাকত না। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সংসদ সদস্য মহোদয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতেই পারেন। কিন্তু যদি বিএনপির যেসব নেতা-কর্মী ঢাকার সমাবেশে গেছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলে থাকেন, তাহলে দেশের আইন ও সংবিধান বদলাতে হবে। সংবিধানে নতুন ধারা যুক্ত করতে হবে যে বিরোধী দলের কোনো সমাবেশে কেউ যোগ দিতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের অনুমতি নিতে হবে। অর্থাৎ এমপির অনুমতি ছাড়া  সমাবেশে যাওয়া আইনত দণ্ডনীয়।

সাইফুজ্জামান শিখরের এই বক্তব্য থেকে প্রশাসন কী বার্তা পাবে? সেখানকার ডিসি-এসপির সাধ্য আছে কি তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়ার? এটা কেবল মাগুরার চিত্র নয়। সারা দেশের।

প্রথম আলোর ফেনী প্রতিনিধির পাঠানো খবরে বলা হয়, ফেনী পৌর বিএনপির আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেনকে (৬০) এলোপাতাড়ি পিটিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার রাত সাড়ে আটটার দিকে পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাসপাতাল সড়কে এ হামলার ঘটনা ঘটে। রক্তাক্ত অবস্থায় ফেনী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। দেলোয়ার হোসেন বিএনপির রাজনীতি করা ছাড়াও ফেনী পৌরসভার সাবেক কমিশনার ছিলেন। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয় ও বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। এ সময় সদর জেনারেল হাসপাতাল সড়কের সিএনজি ফিলিং পাম্পের কাছাকাছি পৌঁছালে একদল দুর্বৃত্ত তাঁর গতি রোধ করে তাঁকে এলোপাতাড়ি পেটানো শুরু করে। তাঁর চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন এ হামলার জন্য স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের দায়ী করে বলেন, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের তালিকা করে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা হত্যার মিশনে নেমেছে। তারা জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি রক্তকণার বদলা নেওয়া হবে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

বিএনপির এই নেতার বক্তব্যে মনে হয়েছে, এবার তারাও মুখ বুজে মার খেতে রাজি নয়। দুই পক্ষই যদি দুই পক্ষকে মোকাবিলা করতে এগিয়ে আসে দেশের অবস্থা কী হবে একবার ভাবুন।

অনেকেই ভেবেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরে বিএনপির সমাবেশের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা কমে আসবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির নেতা-কর্মী উত্তেজনা জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চান।

১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে ঘিরে দলীয় অফিসে পুলিশের অভিযান ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিএনপি ১৩ ডিসেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ ও ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল। ১৩ তারিখে ঢাকায় দলীয় অফিসের সামনের রাস্তাতেই সেই বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। অথচ ৭ তারিখে বিএনপির অফিসের সামনে নেতা-কর্মীদের জমায়েতকে কেন্দ্র করে নানা অঘটন ঘটল। একজন মানুষ মারা গেলেন। দলীয় অফিসে অভিযান চলল। আইন চলে ক্ষমতাসীনদের মর্জিমাফিক।

বিএনপি ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় গণমিছিলের কর্মসূচির দিনই ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। সা্রা দেশ থেকে দলের নেতা-কর্মীরা আসবেন। দলীয় সভানেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন উদ্বোধন করবেন বলে পুরো শহরেই থাকবে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে বিএনপি গণমিছিল করতে চাইলে শহরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।  আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বিএনপি ২৪ তারিখের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। এ খবর সত্য হলে সেটাই রাজনীতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি আনবে। অন্তত আওয়ামী তখন বলতে পারবে না যে বিএনপি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে।

● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com