‘আপনি যখন আপনার মুঠোফোন থেকে অ্যাপ দিয়ে কোনো খাবার অর্ডার করেন, তখন আপনি রিয়েল টাইমে আপনার অর্ডারটির স্ট্যাটাস জানতে পারেন। যেমন আপনি জানতে পারেন, এখন আপনার খাবার প্রস্তুত হচ্ছে বা ডেলিভারিম্যান অর্ডার করা খাবারটি পিক করেছে কিংবা আগামী ১০ মিনিটের মধ্যে খাবার পৌঁছে যাবে ইত্যাদি। কিন্তু আপনি যদি একজন সাধারণ চাকরিপ্রার্থীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন, চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। কেন আপনাকে একটি চাকরির আবেদন করার পর অ্যাপ্লিকেশন স্ট্যাটাস সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারে থাকতে হবে? আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কি এ ধরনের স্বচ্ছতা আনা সম্ভব নয়?’
সম্প্রতি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে মানবসম্পদে প্রযুক্তিবিষয়ক একটি সেশনে একজন বক্তা ওপরের বক্তব্যটি উপস্থাপন করছিলেন।
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির উদ্ভবের পর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই এআই প্রযুক্তি কর্মী নিয়োগপ্রক্রিয়াকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, এ নিয়েই আজকে আমার এই আলোচনা।
কিন্তু বাস্তবে কোনো নিয়োগকারীই প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০০ জন প্রার্থীর ইন্টারভিউ কিংবা লিখিত পরীক্ষা নেবেন না। তাই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে নিয়োগকারী তার এটিএস কিংবা ম্যানুয়াল স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু ক্রাইটেরিয়া যোগ করবেন যেমন, বিশেষ কিছু তথাকথিত অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানি। কিন্তু এর ফলে নিয়োগপ্রক্রিয়াটি হয়ে পরবে পক্ষপাতদুষ্ট।
তবে সাপের বিষের প্রতিষেধক যেমন ওই বিষ থেকেই প্রস্তুত হয়, তেমনি এআই থেকে উদ্ভব সমস্যার সমাধানও ওই এআই থেকেই পাওয়া যাবে। এ সমাধান হলো এআই ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় ভিডিও অ্যাডমিনিস্টার্ড ইন্টারভিউ ও লিখিত পরীক্ষা।
যেকোনো প্রতিষ্ঠান যখন কোনো একটি পদে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করে, যোগ্যতা যাচাইয়ের প্রথম ধাপটি হলো ‘স্ক্রিনিং’। পদটির চাহিদা অনুযায়ী প্রার্থীদের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য যোগ্যতা যাচাই করে প্রথম সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। এ কাজটি করতে প্রতিষ্ঠানটি অ্যাপ্লিক্যান্ট ট্র্যাকিং সিস্টেমের (এটিএস) মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিংবা যাদের এটিএস নেই, তারা কাজটি ম্যানুয়ালি করতে পারে।
এটিএস এ ক্ষেত্রে পদটির জব ডেসক্রিপশন (জেডি) ও পারসন স্পেসিফিকেশন (পিএস) অনুযায়ী প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্তে ওই পদের সংশ্লিষ্ট কি-ওয়ার্ডগুলো সার্চ করে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। আর এ কাজটি ম্যানুয়ালি করলে নিয়োগকারীরা একইভাবে জেডি ও পিএসের ভিত্তিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে বাছাইপ্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন।
ধরুন, একটি শূন্য পদে ১ হাজার জন প্রার্থী চাকরির আবেদন করলেন। এর মধ্যে স্ক্রিনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০ জনকে প্রাথমিকভাবে সাক্ষাৎকারের কিংবা লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করল। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ জনে ২ জন প্রার্থী পরবর্তী ধাপের জন্য নির্বাচিত হলেন।
এখন আসুন আলোচনা করি এই জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি কীভাবে এই নিয়োগপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে?
চ্যাটজিপিটির মতো অনেক ইন্টারনেটনির্ভর টুল আছে, যার মাধ্যমে প্রথমে আপনি কোনো একটি চাকরি বা পদের বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আপনার বর্তমান জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ হওয়ার ক্ষেত্রে কত সম্ভাবনা আছে, তা যাচাই করতে পারবেন। এসব জেনএআই টুল জব ডেসক্রিপশন ও আপনার জীবনবৃত্তান্তটিকে স্ক্যান করে বলে দেবে যে আপনার সঙ্গে কতটা মিলছে। যেমন, শতকরা ৪০ ভাগ বা ৫০ ভাগ মিলছে।
দ্বিতীয় ধাপে ওই একই জেনএআই টুলের মাধ্যমে আপনি ওই পদের জন্য আপনার জীবনবৃত্তান্তটিকে শতকরা ৮০ বা তার চেয়ে বেশি মিলিয়ে নতুনভাবে তৈরি করতে পারেন। এখন আপনি যদি এই নতুন জীবনবৃত্তান্তটি দিয়ে ওই চাকরির জন্য আবেদন করে থাকেন, তবে খুব সহজেই আপনি স্ক্রিনিং বা বাছাইপ্রক্রিয়াটি অতিক্রম করতে পারবেন।
এখন পুরো পরিস্থিতিটি নিয়ে একটু ভাবুন। আপনি যদি আপনার ৪০ শতাংশ মিলে যায় এমন জীবনবৃত্তান্তকে জেনএআই টুল ব্যবহার করে শতকরা ৮০ ভাগ বা ৯০ ভাগ মিলিয়ে বানাতে পারেন, তবে চাকরির বাজারে বাকি প্রার্থীরা কি চুপ করে বসে থাকবেন? অধিকাংশ প্রার্থীই আপনার মতো একইভাবে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে তাঁদের জীবনবৃত্তান্তকেও উন্নত করবেন এবং এটিএস বা নিয়োগকারীর প্রাথমিক বাধা টপকে যাবেন। ফলে আগে যেখানে ১ হাজার জনের মধ্যে ২০ জন বাছাইপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত তালিকা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, জেনএআই টুল ব্যবহার করে শুধু উন্নততর জীবনবৃত্তান্তের কারণে এই তালিকার প্রার্থীর সংখ্যা ২০ থেকে বেড়ে ৫০০ জনও হতে পারে।
এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রার্থীরা একটি নির্ধারিত ওয়েবপেজে লগইন করে একটি ক্যামেরার সামনে তার ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে যাবেন। এআই প্রযুক্তি এই রেকর্ড করা ইন্টারভিউটি বা লিখিত পরীক্ষা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে সঙ্গে সঙ্গেই প্রার্থীর পরীক্ষার স্কোর নির্ধারণ করবে।
এ পদ্ধতিতে নিচের সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে:
১. বেশি পরিমাণে সাক্ষাৎকার (ও লিখিত পরীক্ষা) নেওয়া যাবে এবং কোনো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বা পরীক্ষা হলে পরিদর্শকের প্রয়োজন হবে না।
২. ইন-পারসন ইন্টারভিউয়ের একটি নেতিবাচক দিক হলো জ্ঞাত বা অজ্ঞাত পক্ষপাতদুষ্টতা। ভিডিও অ্যাডমিনিস্টার্ড পদ্ধতিতে সাক্ষাৎকারে এই পক্ষপাতদুষ্টতা ছাড়া ফলাফল পাওয়া যাবে।
৩. এই পদ্ধতি প্রার্থীর জন্যও অনেক সাশ্রয়ী হবে। তাঁকে যানজট ঠেলে এসে কোম্পানির রিসেপশনে পরীক্ষার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না।
৪. প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির পরীক্ষা অনেক দ্রুত প্রার্থীর যোগ্যতা বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তাই অনেক দ্রুততর সময়ে নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে।
৫. এই পদ্ধতিতে পরীক্ষায় প্রার্থী যেন কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে, সে জন্য বিভিন্ন ফিচার থাকে। যেমন কম্পিউটারে পরীক্ষার পেজটি ছাড়া অন্য কোনো উইন্ডো খুলতে না পারা, আই-বল ট্র্যাকিং ফিচার ইত্যাদি।
তবে এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই, এসব সফটওয়্যার কিন্তু এখনো পুরোপুরিভাবে মানুষের বিকল্প হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে এসব সফটওয়্যারভিত্তিক নিয়োগপ্রক্রিয়ার কর্মদক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করছে মাত্র।
যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা এখনো আগের মতোই সুযোগ্য পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা এবং পারদর্শিতার ওপরই নির্ভরশীল। এআই এখনো প্রার্থীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেমন নেতৃত্বদান, টিমওয়ার্ক, মানসিক দৃঢ়তা, সহমর্মিতা এবং প্রতিষ্ঠানের কালচার ইত্যাদি যাচাই করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এসব বিষয়ে আমরা এখনো মানুষের সক্ষমতার ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল।
এখন দেখা যাক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কর্মস্থলে প্রযুক্তি আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সমগ্র বিশ্ব যখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক হারে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে চলেছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো খুব প্রাথমিক পর্যায়ের এইচআরআইএস (হিউম্যান রিসোর্স ইনফরমেশন সিস্টেম), অ্যাটেনড্যান্স ম্যানেজমেন্ট ও অ্যাকসেস কন্ট্রোল সিস্টেম কিংবা পেরোল ম্যানেজমেন্ট নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে।
গত বছর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এইচআর প্রযুক্তিবিষয়ক সেশনে এক বক্তা বলছিলেন, তার প্রতিষ্ঠান এমন একটি এআইনির্ভর সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছে, যা কিনা এমন একটি অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে যা ওই প্রতিষ্ঠানের এমপ্লয়ি টার্নওভার ডেটাবেজ এবং এমপ্লয়ি প্রোফাইল অ্যানালাইসিস করে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্য কোন কোন যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে পারেন, তার একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রস্তুত করে। ওই তালিকার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ কর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ম্যানেজাররা ওই সব কর্মীর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার পরিকল্পনা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
এ পদ্ধতিতে তাঁরা অনেক যোগ্য কর্মীদের প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এখন আমাদের দেশের কথা একবার চিন্তা করুন। এ দেশের দেশীয় ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ ধরনের কার্যক্রম বড়জোর কোনো যোগ্য কর্মী ইস্তফা দেওয়ার পর তাঁর এক্সিট ইন্টারভিউ নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক এইচআর কনফারেন্সে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রায় দুই দশক আগেই এ পর্যায় পেরিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের এই পশ্চাৎ-মুখিতা সত্যিই দুঃখজনক। হতে পারে সস্তা শ্রমের অতীব সহজলভ্যতা আমাদের কর্মক্ষেত্রে এতটা প্রযুক্তিবিমুখ হতে উৎসাহী করেছে।
আশা করি, শিগগিরই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং এ বিষয়ে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের কর্মী বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের নেতৃত্বকেই বুঝতে হবে, যদি আমরা সত্যিই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল হতে চাই, তবে সস্তা শ্রমকে পুঁজি করে এই কাঙ্ক্ষিত অর্জন সম্ভব হবে না। এই যোগ্যতা আমরা একমাত্র আমাদের জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই অর্জন করতে পারব এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার বৃদ্ধির কোনোই বিকল্প নেই।
ইসতিয়াক আহমেদ তাহের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক পরামর্শক