দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কায়ও একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর দেশটিতে রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কার কীভাবে ঘটছে এবং কী কী চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, দেশটির অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের কী শেখার আছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী অভিমত লিখেছেন আলতাফ পারভেজ
বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আগস্ট অভ্যুত্থান নিয়ে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক মহলে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। রক্তাক্ত জুলাই ও আগস্টের বিজয় কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ ও বেলুচিস্তানের তরুণ-তরুণীদের প্রভাবিত করেছে, তার খবর ইতিমধ্যে দেখা গেছে।
এসবে গর্ব করার অনেক কিছু আছে। তবে বাংলাদেশের জন্য দরকারি কিছু আছে সামান্য। বরং ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ অন্য যেসব বার্তা আছে, সেসব এখন বেশি মনোযোগ দাবি করছে।
বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার ২০২২ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পরের দুই বছরের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতাসহ নীতিনির্ধারকেরা খতিয়ে দেখতে পারেন এখন। কেন দুনিয়া কাঁপানো গণ-অভ্যুত্থানের শেষে আগামী মাসে শ্রীলঙ্কা আবারও নির্বাচনের পথে এল, তার পর্যালোচনা বাংলাদেশে বসেও প্রয়োজনীয় হতে পারে।
বাংলাদেশে এখন ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার চলছে। এই অন্তর্বর্তী সময়ের মেয়াদ কত দিনের, সেটা কেউ জানে না। নিঃসন্দেহে এটা মোটাদাগের রাজনৈতিক অস্পষ্টতা। এ রকম অস্পষ্টতার লাভ-ক্ষতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখন কম। কারণ, এ সরকার ছাত্র-জনতাই কায়েম করেছেন। এটা সফল এক গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ফল হিসেবে এসেছে।
যেকোনো সফল গণ-অভ্যুত্থান নিজে থেকে জনগণের একটা ‘যৌথ সাধারণ ইচ্ছা’ আকারে রাজনৈতিক বৈধতার দাবি নিয়ে হাজির হয়। বর্তমান সরকার সেভাবে পেয়েছে বাংলাদেশ।
আবার দেশ তীব্রভাবে উৎসবমুখর একটা নির্বাচনের জন্যও অপেক্ষা করছে। নির্বাচিত সরকারেই যে মানুষের শেষ পক্ষপাত, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও ফিরতে চায় না। ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ও চায়। এ রকম সব চাওয়া মেলাতে গেলে প্রথাগত ঐতিহ্যে বেখাপ্পা লাগে। কিন্তু বলা যায়, এটাই বাংলাদেশের চায়ের আড্ডার চলতি ধাঁধা এখন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৮ আগস্ট কূটনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সবকিছুতে চরম বিশৃঙ্খলা। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমে সংস্কারের পর যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।’ অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রথমে কিছু সংস্কার হবে, তারপর নির্বাচনও হবে।
প্রধান উপদেষ্টা নীতিনির্ধারণী কিছু কথা বললেন এবং গণ-অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিধ্বনি দেখা গেল তাতে। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন।
ছাত্র-জনতা এখন নজর রাখছেন তাঁদের ‘যৌথ ইচ্ছা’র প্রকাশ সরকারের দৈনন্দিন কাজে, প্রতিদিনকার প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলোয়, গুরুত্বপূর্ণ পদের বদলি-নিয়োগ-পদায়নে কতটা পড়ছে। এ রকম পদক্ষেপ গ্রহণের দৈনন্দিন প্রক্রিয়ায় ছাত্র-জনতা নিজেরা কতটা শরিক আছেন, সেটাও নিশ্চয়ই তাঁরা দেখবেন বা দেখছেন। শত শত শহীদের আত্মদানে শুরু হওয়া নতুন সমাজ নির্মাণের কাজ কেবল ২১ জন ব্যক্তির দায় হতে পারে না। তাহলে সেটা পুরোনো ঔপনিবেশিক শাসনপদ্ধতির আরেক দফা অনুশীলন হবে মাত্র।
শ্রীলঙ্কাও অনেকটা একই রকম পরিস্থিতিতে ২০২২ সালটা শুরু করেছিল। প্রথমে তারা দুঃশাসক গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাই মাহিন্দাকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে তাড়ায়। বলা যায়, এ সময় তারা ‘রাজাপক্ষে’ গোত্রের গড়ে তোলা প্রশাসক গোষ্ঠীর ওপরের দিকের পুরোটাকেই তাড়াতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের মতোই জন-আন্দোলনের মুখে সেখানে সর্বোচ্চ নির্বাহী পালান এবং জনতা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখল করে উৎসবে লিপ্ত হয়। সিংহলি ভাষায় লঙ্কানরা সেই অভ্যুত্থানকে বলছিলেন ‘আরগালয়’। আরগালয় মানে, ‘সংগ্রাম’। বাংলাদেশে যেমন আন্দোলনের পরপর ‘রাষ্ট্র সংস্কার চাই’ আওয়াজ উঠেছে দিকে দিকে, শ্রীলঙ্কায় তেমনি বলা হতো ‘সিস্টেম চেঞ্জ’ চাই।
বাংলাদেশে যেভাবে পালিয়ে যাওয়া শাসকেরা কর্তৃত্ব কায়েম করতে গিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছিলেন, রাজাপক্ষেরাও সিংহলি জাতীয়তাবাদের সে রকম এক মডেল ব্যবহার করেন লুটপাটে। তাঁরাও নির্বাচনী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছিলেন। দুর্নীতি ও অপশাসনে অর্থনীতিকে দেউলিয়া করে ফেলেন। যেন তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগোচ্ছিল তখনকার বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী ব্যবস্থা বেশ ভালো। আনুপাতিক ভোটে সেখানে জনপ্রতিনিধি বাছাই হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও আমলাকাঠামো এমন পুরোনো ধাঁচের যে একটা ভালো নির্বাচনও সেখানে জনস্বার্থে কিছু করতে পারে না; বরং উল্টোটা ঘটে। সাংবিধানিক বিধানের জোরে কুলীনেরাই সব নিয়ন্ত্রণ করত তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক পথে’।
এসব ছিল প্রকৃতপক্ষে জনতার কাছে জবাবদিহিহীন এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনপদ্ধতির জের। শ্রীলঙ্কায় যা হয়েছিল, তা যেমন অভিনব ছিল না; বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পতিত দশাও অনুমানহীন ছিল না। ফলে উভয় দেশে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত ছিল এবং সফলও হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় অভ্যুত্থানের পরপর বাংলাদেশের মতো পুরোনো শাসক দল পুরোটা পালিয়ে যায়নি। সংসদ রয়ে গিয়েছিল। সেই সংসদে রাজাপক্ষেদের দলের সদস্যরাও রয়ে গিয়েছিলেন। ফলে রাজাপক্ষেরা ক্ষমতার পরিসর থেকে সরে গেলেও বাংলাদেশের মতো এমন সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, যা পুরোপুরি অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা মতো। বরং পার্লামেন্টের ভেতর ‘আপসরফা’ হয় এবং পুরোনো রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধান করে একটা সরকার হয়।
পার্লামেন্টের ভেতর থেকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ভাবে তৈরি হলেও শ্রীলঙ্কার সরকারও প্রথাগত নির্বাচিত সরকার ছিল না। কারণ, রনিলের দলের সংসদে মাত্র একজন সদস্য ছিলেন। অথচ তাঁর নেতৃত্বের সরকারকে সবাই মেনে নিয়েছিল। সরকার মানাতে গিয়ে ‘ক্ষমতাকেন্দ্র’গুলো থেকে গণ-অভ্যুত্থানের দাবিদাওয়া পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খোদ সমাজে গণ-আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষাগুলোও রয়ে গিয়েছিল। সবাই প্রাথমিকভাবে চাইছিল অর্থনীতির পুনরুদ্ধার।
বাংলাদেশে পুরোনো সরকার বৈদেশিক দেনা রেখে গেছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। অনেকটাই বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি ছিল শ্রীলঙ্কার। ছোট অর্থনীতি সত্ত্বেও ৫১ বিলিয়ন ডলার দেনা বানিয়ে ফেলেছিলেন পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা।
এসব কারণেই এখন থেকে দুই বছর আগে নতুন প্রেসিডেন্ট রনিলও বারবার বলেছেন, ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’। সেই সরকার দুই বছর শেষে এখন দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিচ্ছে। আরও অনেকের পাশাপাশি রনিল বিক্রমাসিংহেও এখন প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন। ৭৫ বয়সী রনিল ইতিমধ্যে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আবারও আগ্রহী!এই মাটির বীর সন্তানদের জন্য রূপকল্প ২০৫০
রাষ্ট্রনৈতিক দিক থেকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের মিল বিপুল। উভয়ে ব্রিটিশ কলোনি ছিল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্রিটিশরা উভয়কে ছেড়ে যায়। তবে এই ‘ছেড়ে যাওয়া’ কেবল শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ছেড়ে যাওয়া। প্রায় ২০০ বছরে নির্মিত পুরো ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোই ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কা ও বঙ্গে (ভারতবর্ষে) রেখে গিয়েছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে নতুন করে মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে বিজয়ী বাংলাদেশেও প্রায় একই আইনি ব্যবস্থা থেকে গিয়েছিল সামান্য কিছু প্রচ্ছদতুল্য পরিবর্তন বাদে।
গত সাত দশকে মূলধারার নির্বাচনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কায় বারবার ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করলেও ঔপনিবেশিক এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার সংস্কার করেনি।
বাংলাদেশের বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো সেখানকার ফ্রিডম পার্টি (এখন পডুজানা পেরামুনা) ও ন্যাশনাল পার্টি বারবার ক্ষমতার মধু খেলেও সমাজে ক্ষমতার বণ্টনব্যবস্থায় কোনো সংস্কার করেনি, যার চূড়ান্ত ফল ২০২২ সালের মার্চে ছাত্র-জনতা যখন ‘আরগালয়’ ঘটান, তখন আর পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকছিলেন না। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন না।
বাংলাদেশে যেভাবে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রশক্তি, তেমনি শ্রীলঙ্কায় আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশন বা আইইউএসএফ ছিল সংগ্রামের সবচেয়ে সাহসী শক্তি।
বাংলাদেশে যে আন্দোলন শুরু হয় অন্যায্য কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শ্রীলঙ্কায় শুরু হয়েছিল জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের বিরুদ্ধে। ইতিহাসের বিস্ময়, ২৪ মাসের ব্যবধানে উভয় দেশে সব ঘটে জুলাইয়ে।
২০২২-এর আরগালয়ের ফল হিসেবে শ্রীলঙ্কার রনিল সরকার যখন ক্ষমতা পায়, তখন তাদের সামনেও আজকের বাংলাদেশের মতো অনেক সংস্কার এজেন্ডা ছিল। শ্রীলঙ্কাও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছিল। তারাও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় প্রাদেশিক সরকারের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন চাইছিল। তামিল-অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এটা খুব জনপ্রিয় দাবি।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী ব্যবস্থা বেশ ভালো। আনুপাতিক ভোটে সেখানে জনপ্রতিনিধি বাছাই হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও আমলাকাঠামো এমন পুরোনো ধাঁচের যে একটা ভালো নির্বাচনও সেখানে জনস্বার্থে কিছু করতে পারে না; বরং উল্টোটা ঘটে। সাংবিধানিক বিধানের জোরে কুলীনেরাই সব নিয়ন্ত্রণ করত তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক পথে’।
এ জন্য ২০২২ সালে পুরো দেশে আরেকটি বড় দাবি ছিল সাংবিধানিক সংস্থাগুলোয় প্রধান নির্বাহী ও শাসক দলের হস্তক্ষেপের রাস্তা বন্ধ করা। বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশনের মতো সংস্থাগুলোয় যেভাবে সমস্যা হতো, শ্রীলঙ্কাও তা থেকে রেহাই চাইছিল। সেখানে সংবিধানের ২০এ অনুচ্ছেদ প্রেসিডেন্টকে দানবীয় ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে; বাংলাদেশের সংবিধান নানা কৌশলে যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় একই ধরনের ক্ষমতাশালী করেছে।
করব করব করেও রনিল সরকার এসব সংস্কার এজেন্ডা নিয়ে এগোয়নি। সরকার ‘অর্থনীতি বাঁচাতে’ গিয়ে আইএমএফের পরামর্শমতো যেসব পদক্ষেপ নেয়, তাতে আন্দোলনের শক্তির একাংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা দেশজ বিবেচনাকে মাথায় রেখে সংস্কার চাইছিল এবং সেটা না হওয়ায় দ্রুত নির্বাচন চাইতে শুরু করে। তখনই দেখা যায়, অনির্বাচিত সরকার হিসেবে এককভাবে কোনো টিমের পক্ষে জাতীয়ভিত্তিক সংস্কার এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এ সুযোগে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে নীরবে তাদের অনাগ্রহ জানিয়ে রাখছিল।
ছাত্র-তরুণদের নতুন সংবিধানের দাবি তাদের কাছে ছিল অতি স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের সাইবার অ্যাক্টের মতো বহু কালো আইন আছে সেখানে। গণ-অভ্যুত্থানের সরকারও সেগুলো কবর দিতে পারেনি।
দেশটিতে বাংলাদেশের মতোই আমলাতন্ত্র খুবই শক্তিশালী। স্বাধীনতার পর থেকে প্রশাসনের জনজবাবদিহি বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ ছিল না, বরং তামিলদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্র শক্তিশালী’ করতে গিয়ে আমলাতন্ত্রকে ধর্ম, অর্থ ও আইনগত উপাদানে সবল করা হয়েছে ক্রমে। তারা একটা অনির্বাচিত সরকারের কাছে সমর্পিত হতে অনিচ্ছুক ছিল।
তা ছাড়া অনির্বাচিত এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সরকারও তাদের ওপর প্রচণ্ড রকম নির্ভরশীল ছিল। চলমান অবস্থার সুবিধাভোগীরা কেন্দ্রীভূত শাসনের মজা ছাড়তে চাইছিল না। গণ-অভ্যুত্থানের সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা রনিলের মন্ত্রীরাও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নিজেদের পছন্দের অদক্ষ লোক দিয়ে ভরে জনগণকে হতাশ করতে শুরু করেন। উল্টো দিকে সময় যত গড়িয়েছে রাজনীতিবিদেরা নির্বাচন পেতে সরব হয়ে উঠছিলেন।
আবার আন্তর্জাতিক মহলও দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে সেখানকার প্রশাসনের আমূল বদল দেখতে চায়নি। তাদের আগ্রহ ছিল কেবল তামিল এলাকার স্বায়ত্তশাসন।
সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কায় যেটা দেখা যাচ্ছিল, ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সমর্থন আছে, এমন কোনো সংস্কারবাদী দল ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়। আবার কথিত সংস্কারবাদীরাও তামিলদের মতো বঞ্চিতদের বেলায় এসে সংস্কার প্রশ্নে ইমান ঠিক রাখতে পারছিলেন না। এর মধ্যে দীর্ঘ সময়ের অনির্বাচিত সরকারে জনসমাজে ক্ষোভ ও অস্থিরতাও বাড়ছিল। তার জের আসন্ন সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে এখনো এ রকম অবস্থা আসেনি। সংস্কার ও নির্বাচনকে সমন্বয় করতে গিয়ে এখানে হয়তো শিগগির সংলাপ হবে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের অভিমত জানাবে। কিন্তু একমত হয়ে কিছু বলতে পারবে কি তারা? এর মাঝে ‘প্রশাসক’দের দিয়ে স্থানীয় সরকার চালাতে গেলে উন্নয়ন-স্থবিরতা আসতে পারে। উন্নয়ন-উদ্যোগগুলোয় জনসম্পৃক্তি ও অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।
আবার নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারহীন পরিবেশে এখনই নির্বাচনও দীর্ঘ মেয়াদে কোনো ভালো ফল আনবে না। এই দুইয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনাই বাংলাদেশে এ সময়ের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তবে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে, সংস্কার উদ্যোগ এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ও ঐক্য দরকার। কিন্তু মানুষের চাওয়ার মতো করে রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুত না হলে বিষয়টি দুরূহ হয়ে যেতে পারে।
আলতাফ পারভেজ লেখক, গবেষক ও বিশ্লেষক