উপজেলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন জিলা স্কুলের মতো হয় না

নক্ষত্র (১১)। মা কুড়িগ্রাম শহরের স্কুলশিক্ষক তৌহিদা খাতুন (৩৫), বাবা প্রভাষক ও সাংবাদিক আবদুল কাদের। পঞ্চম শ্রেণির পর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে। শহরের নামকরা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্র ছিল। লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি, তাই অনলাইনে স্কুলের পছন্দ দিতে হয়। তাঁরা চোখ বন্ধ করে প্রথম পছন্দ হিসেবে কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের নামের জায়গায় টিক চিহ্ন দিলেন। তারপর জেলার অন্যান্য নামীদামি স্কুলের। একই অভিজ্ঞতা সবার বেলাতেই।

শস্য সরকার সংঘ। এ বছর কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তমে উঠল। দিবা শাখায় সর্বোচ্চ নম্বর পেলেও দ্বিতীয় হয়েছে। সে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে আঞ্চলিক পর্বে সেরা দশে ও গণিতে বিভাগীয় বাছাইয়ে পরবর্তী পর্বের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ফিজিকস অলিম্পিয়াডেও নিবন্ধন করেছে। বাবাই একমাত্র রোজগেরে। প্রাইভেট টিউটর নেই, মা-ই পড়ান বাড়িতে।

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যায়নি। সরকারি জিলা স্কুলগুলো যায়নি। কেন গেল না? রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ সব কটি জিলা স্কুল জেলার সেরা স্কুলের মর্যাদা নিয়ে মহীয়ান? কেন সেগুলো এখনো ভরসাস্থল?

অন্যদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো, কিংবা উপজেলাগুলোর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়গুলো? যাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাদের জন্যই সরকারি বিদ্যালয়গুলো। সামর্থ্যবানেরা বেসরকারি স্কুলে পড়ান। খোদ সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা নিজ সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পড়ান। কেন?

২.

শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাইতনতলা গ্রাম যার ঠিকানা। একদম অজপাড়াগাঁ। লণ্ঠনের যুগ সেখানে। ১৯৮৯ সালে বর্তমান লেখক সেই যোগাযোগহীন যুগে আরেক প্রান্তিক এলাকা চিলমারী থেকে পড়তে গিয়েছিলেন। একটা টিনের ঘরে ৫৫ জনের ছাত্রাবাস।

তাঁর মতোই কেউ রংপুর থেকে, কেউ নীলফামারী, কেউ বগুড়া, কেউ গাইবান্ধা থেকে এসেছেন। সেই শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন ৩০০ আবাসিক ও ১১ শ অনাবাসিক শিক্ষার্থী। সরকারি ১৫ জন ও বেসরকারি ৭০ জন শিক্ষক এবং ৪০ জন কর্মচারী। সরকারি বিদ্যালয়ের দুর্দিনে এটি একটি উদাহরণ। উদাহরণ বরাবরই বয়ানের চেয়ে উত্তম।

কেন নামীদামি বেসরকারি স্কুলগুলোতে না গিয়ে শিবরামের দিকে অব্যাহত অগ্রযাত্রা। বুঝলাম, শিবরাম স্কুল নুরুল আলম নামের একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির সাধনা। এটা ব্যতিক্রম। তাহলে সরকারি জিলা স্কুলগুলো?

ছিন্ন মুকুল বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় চিলমারীতে। তারা চিলমারীর তিন স্থানে তিনটি আবাসিক স্কুল গড়ে তোলে। সঙ্গে চিকিৎসা ও কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলে। প্রতিষ্ঠানটি এই অঞ্চলের যুদ্ধশিশু ও গরিব শিশুদের শিক্ষার ভার নেয়। রীতিমতো বিপ্লব ঘটে যায়। দেখা যায়, ৯০/৯১ পর্যন্ত চিলমারীর যত মেধাবী শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন, তার ৮০ ভাগই প্রতিষ্ঠানটির। সব মা–বাবাই সন্তানকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর জন্য ব্যাকুল হন। কিন্তু এখানে কেবল নিতান্ত গরিব ছাড়া কাউকে ভর্তি করানো হতো না। কেন?

সরকারি জিলা স্কুলগুলোতে পড়ছে জেলার কর্তাদের সন্তানেরা। উপজেলার সরকারি স্কুলগুলোতে শীর্ষ কর্তাদের সন্তানেরা কি পড়ে? উপজেলাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো কি থাকে? পরিবার থাকলেও সন্তানেরা কি থাকে? উত্তর হলো, না।

৩.

অনেকগুলো বৈপরীত্য, অনেকগুলো কেন। শিক্ষকের ঘাটতি? শিক্ষকের ঘাটতি হলে যেসব স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কম, সেগুলোতে ভালো লেখাপড়া হওয়ার কথা। তাহলে শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতি? তাহলে তো বেসরকারি স্কুলগুলোর ভালো করার কথা নয়। কারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই স্নাতকোত্তর পাস, সে তুলনায় বেসরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষকেরা উচ্চমাধ্যমিক পাস। কম শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে তাঁরা ভালো করেন কীভাবে?

অবকাঠামো নিশ্চয়ই? তাহলে তো ১০০ ভাগ সরকারি স্কুলগুলো বেসরকারি স্কুলগুলোর চেয়ে উন্নত হতো। কারণ, সব কটি সরকারি বিদ্যালয়ে মাঠ আছে। স্কুল মেরামতের টাকা দুর্নীতিমুক্তভাবে খরচ করলে বেসরকারি স্কুলের চেয়েও দৃষ্টিনন্দন করা সম্ভব। সেটা হচ্ছে না কেন?

তবে কি দায় ব্যবস্থার, নজরদারির? হ্যাঁ, তা–ই। কারণ, সরকারি জিলা স্কুলগুলোতে পড়ছে জেলার কর্তাদের সন্তানেরা। উপজেলার সরকারি স্কুলগুলোতে শীর্ষ কর্তাদের সন্তানেরা কি পড়ে? উপজেলাগুলোতে সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবারগুলো কি থাকে? পরিবার থাকলেও সন্তানেরা কি থাকে? উত্তর হলো, না।

বালক-বালিকা মিলে দুটি স্কুলে জেলার তাবৎ কর্তাদের সন্তানেরা পড়ে। ওই স্কুল দুটিতেই শীর্ষ শিক্ষা কর্তাদের নজর। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যেই থাকে। কিন্তু উপজেলাপর্যায়ে গড়ে তিনটা স্কুলের জন্য যেখানে একজন শিক্ষা কর্মকর্তা দরকার, সেখানে ৩০টি স্কুলপ্রতি একজন। স্থানীয় শাসনের (সংবিধানে স্থানীয় সরকার বলে কিছু নেই।) স্তর হিসেবে উপজেলাকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। উপজেলাগুলো তাই প্রশাসনিক কর্তাদের জন্য বাসযোগ্য নয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ওসি ছাড়া কেউ কর্মস্থলে থাকেন না পরিবারসহ। সামর্থ্যবানেরা সবাই বিভাগীয় শহরমুখী। এখানেও সংকট ওই সাংবিধানিকই। সংবিধান সংস্কার করে স্থানীয় শাসনের বদলে যদি স্থানীয় সরকার সম্ভব হয়, তখনই কেবল উপজেলা জাগবে। উপজেলায় যথার্থ স্থানীয় সরকার হলে উপজেলা পরিষদ প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা নিয়োগের সক্ষমতা অর্জন করবে।

উপজেলায় সব কর্মকর্তা সপরিবার থাকতে বাধ্য হবেন। হাসপাতাল উন্নত হবে। আইজিপি, এসপির নির্দেশে নয়, পুলিশ চলবে উপজেলা পরিষদের অধীনে। আর উপজেলার চেয়ারম্যানেরা জনগণ কর্তৃক যেকোনো সময় প্রত্যাহারযোগ্য হওয়ায় জনগণের পূর্ণ কর্তৃত্বে থাকবে। তখনই কেবল সরকারি বিদ্যালয়গুলো নজরদারিতে আসবে। নইলে নৈবচ।

  • নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
    nahidknowledge1@gmail.com