ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা। ভারি অস্ত্র হাতে রাজধানীর তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরতাফা বিন ওমর। রাজধানী ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায়। ৪ আগস্ট।
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা। ভারি অস্ত্র হাতে রাজধানীর তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরতাফা বিন ওমর। রাজধানী ঢাকার উত্তরার আজমপুর এলাকায়। ৪ আগস্ট।

মতামত

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্ন: সমাধানের পথ কী

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বিচার রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদী হামলা ও সামাজিক দাঙ্গার মধ্যে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এ বছরের মধ্য জুলাই ও আগস্টের প্রথম ভাগে। আর্মার্ড কারের ওপর যুবকের লাশ, রিকশার পাদানিতে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তরুণের আকুতিময় চোখ, হেলিকপ্টার থেকে বাছবিচারহীন গুলিতে শিশুর মৃত্যু...মানুষের জীবন যেন মূল্যহীন, জীবন নেওয়া যেন ভিডিও গেমসের মতো খেলা!

সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান শেখ হাসিনা এবং সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও জোরালো নির্দেশ ছাড়া হাজারো মানুষকে হত্যা ও গুরুতর আহত করার সম্ভাবনা কম। তাই শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সুষ্ঠু বিচার জরুরি। এই বিচারে গাফিলতি বা ঢালাও হত্যা মামলা দেওয়া হবে, এ ঘটনাকে হালকা করে ফেলার শামিল।

হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে এখন বিতর্ক চলছে। ২৩ জুন ১৯৪৯ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে এ দলটির জন্ম। ১৯৫৫ সালে মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করতে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে, তা শুধু দুঃখজনক নয়, বরং বিচারযোগ্য।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দল, যাদের সমর্থকগোষ্ঠী বিশাল, তাদের সংস্কার, মোকাবিলা বা বিচার কীভাবে করলে কার্যকর হয় এবং ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনগুলো বাদ দিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৩০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, ১৯৯৬ (জুন) সালে ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ২০০১ সালে ৪০ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০০৮-এ জোট বিবেচনা না করে শুধু দল হিসেবেই পায় ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ভোট।

গত ১৫ বছরে সুষ্ঠু ভোট না হওয়া, জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়ন—এ তিনটি কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটুকু কমেছে, তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আচরণ ও বক্তব্যে এ নিয়ে অনুশোচনা লক্ষ করা যায় না। তাই যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কোটি মানুষের পরিণতি এর সঙ্গে জড়িত। তাই এ বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত হঠকারিতা নয়, বরং কার্যকর আলোচনা ও চিন্তার মাধ্যমেই হওয়া উচিত।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করতে আমরা কয়েকটি সম্ভাব্য বিকল্প দৃশ্যপটের কথা চিন্তা করতে পারি। প্রথম দৃশ্যপট, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে। এ সিদ্ধান্ত আসতে পারে তিনটি প্রক্রিয়ার যেকোনো একটির মাধ্যমে, আদালতের নির্দেশে, গণভোট অথবা নির্বাহী আদেশে। আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ করার আবেদন করলে প্রমাণ করতে হবে যে দল হিসেবে গণহত্যায় আওয়ামী লীগ জড়িত ছিল কি না, দলীয় সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী ছিল, দলের প্রধানের জড়িত থাকার প্রমাণ আছে কি না। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যে কাজের সীমানাগত পার্থক্য, তা-ও এখানে দেখতে হবে।

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সাংস্কৃতিক মূলধন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অনেক মহারথী ও মতামত প্রভাবক আওয়ামী লীগের শক্তি। তাই দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগকে স্বল্পমেয়াদি নিষিদ্ধ করলে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।

গণভোটে গেলে এ বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত জানা যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, নির্বাচন ও রেফারেন্ডামের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে ম্যান্ডেট এলে তা শুধু মেনে নিতে হবে তাই না, এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারেও পড়তে পারে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে যদি জনগণ রায় দেয় এবং যদি শতকরা ২০/৩০ ভাগও এর বিপক্ষে ভোট দেয়, তবে তা-ও একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। কয়েক কোটি সমর্থক, যাদের মধ্যে নব্বই ভাগই সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত না থাকারই কথা। এই নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে তাদের ‘ক্রিমিনালাইজড’ করা হতে পারে; যা হিতে বিপরীত হয়ে উঠতে পারে।

দ্বিতীয় দৃশ্যপট, জুলাই-আগস্টে নির্বিচার হত্যা ও এর আগে গত ১৫ বছরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সংস্কারের সুযোগ দেওয়া। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সে ক্ষেত্রে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, পেশাদার ও আন্তর্জাতিক মানের সত্যানুসন্ধানী কমিটি তৈরি করে হাসিনাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের যেসব নেতা-কর্মী মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সবার একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা যেতে পারে।

এ তালিকায় থাকা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার যৌক্তিক ভিত্তি থাকলে বিচারপ্রক্রিয়ার সময়ই তাঁদের রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নিষেধ থাকতে পারে। কিন্তু তা ‘অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ’ ন্যায়বিচারের এই মূলকথার সঙ্গে যেন তা সাংঘর্ষিক না হয়, সে জন্য আইনি ব্যবস্থা খুঁজে বের করা দরকার হবে।

যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের দলীয়ভাবে বহিষ্কার ও আওয়ামী লীগের দলীয় সংবিধানে এ হত্যাকাণ্ড ও হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার ধারা যুক্ত করার পর দলটি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদের বিচারের মুখোমুখি করে রাজনীতি ও দলীয় কাঠামো থেকে তাঁদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং অপেক্ষাকৃত কম অপরাধের সঙ্গে জড়িত দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ও সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে এনে দলটির কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়া যায়।

তৃতীয় দৃশ্যপট, স্থিতাবস্থা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করা এবং কোনো কার্যকর বিচার ও সংস্কার না করা। এটি অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব। কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই বর্তমান আওয়ামী লীগ আবার ফিরে এলে দেশে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বাড়বে। কোনো ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রথম দৃশ্যপট অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা হলেও কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা যে কম, তা ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামীসহ পাঁচটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান অনুযায়ী সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এ সময় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে আবার কার্যক্রম চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়। এই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা, কোনো সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নিষিদ্ধঘোষিত দলগুলো থেকে নেতা-কর্মীরা জাসদ, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগেও যোগ দিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে গত ৩১ জুলাই। কিন্তু দলটি যে আরও বড় কলেবরে ফিরে এসেছে, তা এখন স্পষ্ট।

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সাংস্কৃতিক মূলধন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অনেক মহারথী ও মতামত প্রভাবক আওয়ামী লীগের শক্তি। তাই দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগকে স্বল্পমেয়াদি নিষিদ্ধ করলে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।

  • ড. সাইমুম পারভেজ জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক