গাইবান্ধার উপনির্বাচন: এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা নয়তো?

ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখে নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা–৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের বিক্ষোভ
ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধা-৫-এর উপনির্বাচনে একটি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেল। এই প্রথমবারের মতো আমাদের জানামতে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি সংসদীয় আসনের নির্বাচন—যদিও এটি ছিল উপনির্বাচন—মাঝপথে স্থগিত করা হলো। এ সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাধুবাদ জানাই। এটা ভালো লক্ষণ যে, কমিশনের বোধোদয় হয়েছে যে যেনতেন প্রকারে নয়, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করাই কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নির্বাচন স্থগিত, নির্বাচনী ফলাফল বাতিল ও নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ প্রদানের এখতিয়ারও কমিশনের রয়েছে।

লক্ষণীয় যে, গাইবান্ধার উপনির্বাচনটি এমন একটি সময়ে হয়েছে যখন নির্বাচন কমিশন, নিজের স্বীকারোক্তিতেই, চরম আস্থার সংকটে ভুগছে। বর্তমান কমিশনের নিয়োগের ব্যাপারে ছোট দলগুলোর কিং মেকার হওয়ার অভিযোগ, তরিকত ফেডারেশনের আবারও একাধিক কমিশনারের নাম সফলভাবে প্রস্তাবের দাবি, অনুসন্ধান কমিটির পক্ষ থেকে কারা কার নাম প্রস্তাব করেছেন, তা প্রকাশে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা চূড়ান্ত ১০ জনের নাম প্রকাশে অনুসন্ধান কমিটির অস্বীকৃতি ইত্যাদি কারণে শুরু থেকেই সন্দেহ ও বিতর্ক নিয়ে আওয়াল কমিশনের যাত্রা শুরু হয়।

কুমিল্লার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রয়োগে অপারগতা, এ নিয়ে পরবর্তীকালে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান এবং সেখানকার নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে একধরনের নাটকীয়তার কারণে কমিশনের ওপর আস্থাহীনতা চরম আকার ধারণ করে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত; পরবর্তী সময়ে নিজেদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের মতামত পাল্টে দেওয়া; প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত এবং ইভিএম ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারেনি—এমন ধূম্রজাল সৃষ্টি করা, যদিও এ অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই; ইত্যাদি কারণে কমিশনের প্রতি আস্থা রাখা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি দলের প্রতি অনুগত হওয়ার গুরুতর অভিযোগ ব্যাপক। প্রসঙ্গত, আমরা আমাদের একটি ইভিএম এবং এর সোর্সকোর্ড দেওয়ার লিখিত দাবি কমিশনকে জানিয়েছি, যাতে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে এই ইভিএম ব্যবহার করার মাধ্যমে বেড়ায়ই খেত খেয়ে ফেলতে পারে।

অতীতে যে কোনো নির্বাচনের শেষে সাধারণত নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে অনিয়মের অভিযোগ তুললেও কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করা হতো। তাই এবারকার ব্যতিক্রম সন্দেহের উদ্রেক করাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে উপনির্বাচনে অনিয়মের জন্য সরকারি দলের লজ্জিত ও দুঃখিত না হওয়ার পরিবর্তে কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতি অবিচার করার জোরালো অভিযোগ আনায় এ সন্দেহকে ঘনীভূত না করে পারে না।

এমনি প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের আটঘাট বেঁধে ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে গাইবান্ধা উপনির্বাচনে ভোট ডাকাতি উদ্‌ঘাটনের সর্বাত্মক চেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখলেও, এটি প্রশ্নের উদ্রেক না করে পারে না। কারণ অতীতে যে কোনো নির্বাচনের শেষে সাধারণত নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে অনিয়মের অভিযোগ তুললেও কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠু হওয়ার দাবি করা হতো। তাই এবারকার ব্যতিক্রম সন্দেহের উদ্রেক করাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে উপনির্বাচনে অনিয়মের জন্য সরকারি দলের লজ্জিত ও দুঃখিত না হওয়ার পরিবর্তে কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতি অবিচার করার জোরালো অভিযোগ আনায় এ সন্দেহকে ঘনীভূত না করে পারে না। কারণ, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে কমিশনের পক্ষ থেকে কারচুপি উদ্‌ঘাটনের জোরালো প্রচেষ্টা এবং ক্ষমতাসীনদের কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা উভয় পক্ষের জন্যই ‘উইন-উইন’-এর মাধ্যমে আওয়াল কমিশন যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং তারা যে ক্ষমতাসীনদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নয়, তা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি বিষয়টি কাকতালীয়। যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে এ নাটকে প্রযোজকের কূটবুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। কারণ, এর মাধ্যমে একই ঢিলে দুই পাখি মারার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

গাইবান্ধার উপনির্বাচনের পর গণমাধ্যমের সামনে প্রদত্ত বক্তব্যে কমিশন কয়েকটি বিষয়ে আবারও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। প্রথমত, তারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে যে, ইভিএম নিয়ে একমাত্র সমস্যা হলো বুথে ডাকাতের উপস্থিতি। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে সুরম্য ভবনে স্যুট-কোট পরে বসে থাকা ও ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের দ্বারা প্রযুক্তিগতভাবে এ দুর্বল যন্ত্র ব্যবহার করে সম্পূর্ণ গোপনে যে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব, তা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, ভোটে কারচুপির মোক্ষম সমাধান হলো ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে যেখানে অন্তত ৪৫ হাজার কেন্দ্র থাকবে এবং নির্বাচনী কক্ষ হবে তার অনেক গুণ বেশি, সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে নির্বাচনের সুষ্ঠু নির্ধারণ করার আশা কল্পনাকেও হার মানায়।

লক্ষণীয় যে, গাইবান্ধা উপনির্বাচনে অনিয়মের জন্য কমিশন নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে, যেগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরপিওর ধারা ৮১(১)(চ), ৮১(২), ৮৩(১), ৮৪, ৮৫ ও ৮৬ অনুযায়ী এগুলো শাস্তিযোগ্য নির্বাচনী অপরাধ। উদাহরণস্বরূপ, আরপিওর ৮৬ ধারা অনুযায়ী, ‘যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি কোনোভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করিবার উদ্দেশ্যে তাহার সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক [পাঁচ বৎসর এবং অন্যূন এক বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডও] দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইবেন।’ এখন দেখার বিষয়, কমিশন অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কি না। এর মাধ্যমেই তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

গাইবান্ধার উপনির্বাচন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বয়ে আনল। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না চাইলে সামান্য একটি উপনির্বাচনেও কমিশনের পক্ষে তার সুষ্ঠু নির্বাচনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পালন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে তারা তাদের অস্ত্রভান্ডারে থাকা ‘নিউক্লিয়ার অপশন’ ব্যবহার করে কারচুপি ও বিতর্কিত নির্বাচন ঠেকাতে পারে। তারা নির্বাচন স্থগিত অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জানাতে পারে এবং নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করতে পারে। গাইবান্ধার উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আবারও প্রমাণিত হলো যে, দলীয় সরকারের অধীনে একটি সাধারণ উপনির্বাচনও, যার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল হবে না, কমিশনের পক্ষে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ হলো দলীয়করণ। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এমনকি নির্বাচন কমিশনেরও দলীয়করণ হয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে চারটি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং সেগুলোয় ক্ষমতার রদবদল হয়েছে। এগুলো দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অন্য সাতটি নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে, যার দুটি ছিল একতরফা এবং এগুলো কোনো নির্বাচনই ছিল না। কারণ, নির্বাচন মানেই বিকল্প থেকে বেছে নেওয়া। এই সাতটি নির্বাচনই (যার মধ্যে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত) ছিল বিতর্কিত ও একতরফা, এমনকি কোনো কোনোটিতে চরম জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল। এগুলো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অর্থাৎ আমাদের অতীতের এবং গাইবান্ধার উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা বলে যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি ঠেকাতে হলে কমিশনকে তাদের হাতে থাকা নিউক্লিয়ার অপশন আবারও ব্যবহার করতে হবে—নির্বাচন স্থগিত করতে হবে। তাই তাদের এখনই সরকার ও রাজনৈতিক দলকে বলতে হবে যে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত আমাদের সংবিধানিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পালন করা সম্ভব হবে না। সংসদে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীনরা অতি সহজেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। একই সঙ্গে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুর্বল ও জালিয়াতির যন্ত্র ইভিএম ব্যবহার থেকে কমিশনকে সরে আসতে হবে। এতে বর্তমান অর্থনৈতিক দুঃসময়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকারও সাশ্রয় হবে।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার সুজন–সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক